পুস্তক পরিচয় ১...
তাঁর পথে আমরা চলতে পারিনি
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, রবীন মজুমদার। চর্চাপদ, ২০০.০০
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞান রচনাসংগ্রহ, সম্পাদনা সুবিমল মিশ্র। পরি: দে বুক স্টোর, ২৭৫.০০
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের শিক্ষাভাবনা, সম্পাদনা সুবিমল মিশ্র। পরি: ঐ, ২৫০.০০
বিজ্ঞান চর্চার লক্ষ্য, আদল, ঢঙ, প্রকরণ, যান্ত্রিক উপযোগ, সব কিছুই আমরা পশ্চিমি দুনিয়া থেকে ধার করেছি। এ সবের ক্ষেত্রে নতুন দিশা বা সংকেতনির্দেশে আমরা প্রধানত ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার বেদনা শুধু বশ্যতা স্বীকারে ও অনুকরণে বাধ্য থাকার জন্য নয়, এর ভিত্তি আরও গভীরে। ‘প্রকৃতির নিয়ম’-এর বিশ্বজনীনতা মেনে নিলেও, অনুসন্ধানের ক্ষেত্র, ঝোঁক, ধরন, প্রকরণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৈচিত্রের সুযোগ থাকে। একই পৃথিবী। কিন্তু মাটি, পাথর, জল, বায়ু, প্রাণী, উদ্ভিদ দেশে-দেশে, প্রদেশে-প্রদেশে, এমনকি জেলায়-জেলায় আলাদা। আমাদের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে জানার, বোঝার চেষ্টায় আমরা কতদূর সফল? বিজ্ঞান গবেষকের সংখ্যায় আমরা বহু দেশের থেকে এগিয়ে। কিন্তু প্রকৃতি, পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র অনুযায়ী শিল্প, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান-গবেষণাকে গড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কতটা উদ্যোগী? উত্তর অজানা নয়।
কিন্তু আমাদের দেশে সে চেষ্টা যে একেবারে হয়নি তা নয়। আর যিনি আজীবন বিজ্ঞানকে স্বদেশমুখী ও দেশোপযোগী করে তোলার চেষ্টা করেছেন, তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর ও হরপ্রসাদের জাতীয়তাবাদের অন্তরে ছিল দেশের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, মাটি, জল, বায়ু ও প্রাণজগৎকে তাদের নিজেদের মতো করে জানার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র সৌধ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। এ শুধু পশ্চিম থেকে ধার করা জ্ঞানার্জনের হাতিয়ার ব্যবহার করে দেশকে জানা নয়, এই প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসা ও জানার উপকরণকে বিষয়োপযোগী, দেশোপযোগী করে তোলা। এই অনুপ্রেরণা প্রফুল্লচন্দ্রেরও। তাই, শুধু রসায়নের গবেষণায় আটকে না থেকে দেশের কিমিয়াবিদ্যার ইতিহাস জানার বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে এল বিজ্ঞানের বিকাশ ও অধোগতির প্রথম যথার্থ সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, যা নতুন করে ফিরে আসে কয়েক দশক পরে, ইয়োরোপীয় বিজ্ঞান-ঐতিহাসিকদের রচনায়। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, প্রফুল্লচন্দ্রের রচনাতেই এই জাতীয় ব্যাখ্যার সূত্রপাত। কিন্তু এই অবদান আজও তার প্রাপ্য স্বীকৃতি পায়নি।
প্রফুল্লচন্দ্রের সার্ধশতবর্ষের উদযাপন ঘটা করে হল। কিন্তু এ-সব আলোচনা প্রধানত বাদ থেকে গেল। এই ফাঁক অনেকটাই ভরাট করেছে রবীন মজুমদারের আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র গ্রন্থটি। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের বৌদ্ধিক ও সামাজিক ভূমিকার চরিত্র অনুধাবনের নিরিখে তিনি প্রফুল্লচন্দ্রের উত্তরাধিকারকে বুঝতে চেয়েছেন। এই তাগিদ থেকে তাঁর পাঁচটি প্রবন্ধ আগেই প্রকাশিত। তার সঙ্গে আরও তিনটি যুক্ত করে তৈরি হয়েছে বইটির আটটি ‘তরঙ্গ’। যেমন, ‘প্রফুল্লচন্দ্র ও পরিবেশ’, ‘সবুজ ও স্থিতিশীল রসায়ন শিল্পের অগ্রদূত’, ‘প্রফুল্লচন্দ্র কি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন’ এবং ‘প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞানবোধ’।

কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে
বিদেশি অভ্যাগতদের সঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৯৩৮)।
গবেষণাগারে ছাত্রদের প্রতি প্রফুল্লচন্দ্রের কঠোর নির্দেশ ছিল জল ও বিকারক নষ্ট না করার। নির্দেশ ছিল পারদ, প্ল্যাটিনাম, সোনা, রুপো মেঝেতে পড়ে গেলে যথাসম্ভব পুনরুদ্ধার করে পুনর্ব্যবহার করার। এর পেছনে প্রধান কারণ বোধহয় ছিল অর্থের অপ্রতুলতা। কিন্তু রাসায়নিকের অপচয় রোধ এবং সেগুলিকে পরিবেশে মুক্তি পেতে না-দেওয়া, আজকের সবুজ রসায়নের অন্যতম প্রধান বুনিয়াদ। যদিও প্রফুল্লচন্দ্র ‘সাস্টেনেবল’ (রবীনবাবুর পরিভাষায় ‘স্থিতিশীল’) উন্নয়নের কথা শোনেননি, তাঁর তৈরি বেঙ্গল কেমিক্যাল ‘স্থানীয় কাঁচামাল, বর্জ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা, ভূমিপুত্রদের সাহায্যে, তাদের উদ্ভাবনীশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং স্থানীয় বাজারের চাহিদা ও প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে...’। অন্তত, প্রফুল্লচন্দ্র যতদিন তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ততদিন। দেশের প্রয়োজন দেশীয় উপাদান দিয়ে মেটাতে চেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, তাই তাঁর কাজে আজকের উন্নয়নের পথনির্দেশও মেলে।
রসায়নবিদ হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্রের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তিনি গবেষণাগারে মার্কিউরাস নাইট্রাইট সত্যিই প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন কি-না, এই নিয়ে সম্প্রতি সংশয় দেখা দিয়েছিল। ‘প্রফুল্লচন্দ্র বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করেই’ অনিমেষ চক্রবর্তী ও তাঁর সহকর্মীরা মার্কিউরাস নাইট্রাইটের হলুদ রঙের কেলাসাকার পদার্থ দ্রবণ থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্রের কীর্তিকে শুধুমাত্র রাসায়নিক সাফল্যের নিরিখে বিচার করলে ভুল হবে। তাঁর বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসা বিজ্ঞান গবেষণার সংকীর্ণ সাবেকি গতে আবদ্ধ থাকেনি। দেশবাসীর কল্যাণসাধনের প্রেরণা ও অদম্য অনুসন্ধিৎসা তাঁকে ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক কুফল বুঝতে আগ্রহী করেছে, দেশীয় বিজ্ঞানের অবক্ষয়ের কারণগুলি খুঁজতে উৎসাহিত করেছে, প্রথম রাসায়নিক গবেষণাতেই ভোজ্য তেলে ভেজাল শনাক্তকরণে ব্যগ্র করেছে, আধুনিক রাসায়নিক শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলার পথসন্ধানের সাহস জুগিয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্র ও তাঁর ছাত্ররা বাংলায় অলংকার প্রস্তুতিতে সোনার অপচয় প্রসঙ্গে যে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, তার একটি বিস্তারিত ও প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। তাতে জানা যায়, কী যত্নের সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্ররা দেশীয় কারিগরদের পদ্ধতিগুলির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে, প্রথাগত কারিগরি জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক রাসায়নিক জ্ঞানের সংযোগ ঘটিয়ে অপচিত সোনার একটা বড় অংশের পুনরুদ্ধার সম্ভব। এ প্রসঙ্গে রবীনবাবু অপচিত সোনার সঙ্গে দূষণের প্রশ্নটিও যুক্ত করেছেন। লিখেছেন, ‘আজও কলকাতার বিশেষ বিশেষ জন-অধ্যুষিত এলাকায় (যেমন শাঁখারিপাড়ায়) বিশাল বিশাল অট্টালিকার খুপরি খুপরি ঘরে প্রফুল্লচন্দ্র বর্ণিত পদ্ধতিতেই কাজ চলছে।... ক্লোরিন অ্যাসিড বাষ্প নাইট্রোজেন অক্সাইডের ধোঁয়ার মানবশরীরে ধ্বংসলীলা অব্যাহত অপ্রতিহত আজও। প্রফুল্লচন্দ্রের দেওয়া সূত্র অনুসরণে আমরা স্বর্ণালঙ্কারশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারতাম। একটি স্বর্ণশিল্পগ্রাম বা ওই জাতীয় ক্লাস্টারে সবার জন্য ল্যাবরেটরি এবং দূষণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারতাম।... কিন্তু আমরা পারিনি। আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতা তো প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞানবোধের মতো নয়।’ শেষ খোঁচাটির কিছুটা তাৎপর্য বোঝা কঠিন নয়। বাকিটুকু অনুধাবন ও উপভোগের জন্য বইটি পড়তে হবে।
বানান-বিভ্রাট প্রায় নেই। তবে, বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধ সংকলিত হওয়ায় কিছু পুনরাবৃত্তি রয়েছে। একটি জায়গায় আলোচনা একটু অস্পষ্ট। যেমন, বিজ্ঞানীর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধ এবং তার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে। কেউ নিজের আর্থিক উন্নতি প্রভৃতির তোয়াক্কা না করে নিজের বৈজ্ঞানিক মেধা মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবেন কি-না, বা পরিবেশের প্রশ্নটিকে কেউ শুধু মানব প্রজাতির কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন কি-না, সে সব সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত, দার্শনিক, কিংবা নৈতিক। সেগুলিতে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রশ্ন অবান্তর। রবীনবাবু হয়তো এই কথাই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু আলোচনা খুব স্পষ্ট হয়নি।
সুখপাঠ্য বইটি শেখায়, ভাবায়। প্রফুল্লচন্দ্রের উত্তরাধিকার, ভারতীয় জ্ঞান চর্চার ইতিহাস ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মনোজগতের আলোচনার ক্ষেত্রে এটি মূল্যবান সংযোজন। আর তা শুধু বাংলায় প্রকাশিত বইয়ের নিরিখে নয়। বাঁধাই, কাগজ, প্রচ্ছদ, সব দিক থেকেই বইটি দৃষ্টিনন্দন।
প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞানবিষয়ক বাংলা রচনা আগেও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ছাপার ভুল চোখে পড়ে। মূল প্রবন্ধের পাঠ, বানান ও সঙ্গের ছবিগুলি অবিকৃত রেখে সংকলিত করেছেন সুবিমল মিশ্র। একই ভাবে সংকলিত করেছেন প্রফুল্লচন্দ্রের শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি। সম্পাদকের প্রাককথনগুলি তথ্যসমৃদ্ধ। পাঠক ও গবেষকরা উপকৃত হবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.