মুখোমুখি ২...
‘পাওলো রোসি আমার খুড়তুতো ভাই’

পত্রিকা: ভারতের নামটা মাথায় এলে সবার আগে কী ভেসে ওঠে চোখের সামনে?
ফালোপা: অমিতাভ বচ্চন, শশী কপূর, ইন্দিরা গাঁধী এবং অমর্ত্য সেন।

পত্রিকা: মুখোমুখি দেখা হয়েছে কখনও?
ফালোপা: সেই সৌভাগ্য হয়নি কখনও। লোকের মুখে আর টিভি-র পর্দাতেই যা আলাপ (মিচকে হাসি)। আমার ছেলে (আমেরিকো) তো অমিতাভের অন্ধ ভক্ত। ওই একটা সিনেমা আছে না অমিতাভ রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে ছুটছিল...

পত্রিকা: কুলি?
ফালোপা: হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই দৌড়নোর দৃশ্যটা আমেরিকো-র খুব প্রিয়। বাড়ির লনে যে কত বার নকল করার চেষ্টা করেছে, তা আর বলার নয়! অমিতাভ টিভি-র পর্দায় নাচত। আমার ছেলে সেগুলো দেখে দেখে ঘরে ওর কোমর দোলাত। (বাবাকে রসিকতা করতে দেখে তখন ছেলে আমেরিকোও উত্তেজিত)
আমেরিকো: তুমি কী করতে, বলি?
ফালোপা: কেন?
আমেরিকো: (প্রতিবেদকের দিকে বড় বড় চোখে তাকালেন) জানেন, টিভি-তে শশী কপূরের সিনেমা চললে, আর চ্যানেল ঘোরাতে দিত না বাবা।

পত্রিকা: আর আনা (টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে ফালোপার স্ত্রী) আপনি?
আনা: আমিও বলিউডের সিনেমা দেখতে ভালবাসি। তবে এতটা পাগলামি করি না (হাসতে হাসতে)। বরং মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে বেশি ভাল লাগে।

পত্রিকা: আপনার ফুটবলের প্রতি ভালবাসা তৈরি হল কী ভাবে?
ফালোপা: ব্রাজিলে ফুটবল শুধু খেলা নয়। ক্যানসারের মতো রোগ। আমরা ছোটবেলা থেকে এই রোগ সঙ্গে নিয়েই জন্মাই। আমার বাবা ফুটবলার না হলেও, এক জন অন্ধ ফুটবল-ভক্ত ছিলেন। বাবার হাত ধরেই প্রথম স্টেডিয়ামে ম্যাচ দেখতে আসা।
পত্রিকা: একশোর ওপর দেশ ঘুরেছেন আপনি। হঠাৎ কলকাতা ফুটবলের প্রতি টান জন্মাল কী করে?
ফালোপা: ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করানোর প্রস্তাব পাঁচ বছর আগেই পেয়েছিলাম। মায়ানমারের চুক্তি ভেঙে তখন আসতে পারেনি। এ বারও শুরুতে বেশ কিছু সমস্যা হয়েছিল। ফিফা ইন্সট্রাক্টর বলে সারা বছর ওদের হয়ে কিছু না কিছু কাজ করতে হয়। কিন্তু আমি সাফ বলে দিয়েছি, এক বছর ইস্টবেঙ্গল ছাড়া আর কোনও বিষয় নিয়ে ভাবব না।

পত্রিকা: আর আমেরিকো আপনি? (চিকেন উইংস খেতে ব্যস্ত)
আমেরিকো: আমি চোদ্দো বছর ধরে এই পেশায় আছি (আরও একটা চিকেন উইংসে কামড় মেরে নিলেন)। ভারতে আসার আগে আমি ইউটিউবে, ভারতের বিভিন্ন খবরের কাগজে ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে খোঁজ-খবর করে নিয়েছি। আমার ফিয়াঁসে নাতালেও আমাকে খুব সাহায্য করেছে। ও অফিসের কাজে এই বছরের শুরুতে ভারতে তিন মাসের জন্য এসেছিল। এখানে থেকে ও আমার জন্য বিভিন্ন খেলার সিডি-ডিভিডি জোগাড় করে নিয়ে যায়।

পত্রিকা: আপনি তো শুরুতে ফুটসাল খেলতেন। সেখান থেকে পেশাদার ফুটবলে...
ফালোপা: (চামচে করে এক গাল ভাত মুখে দিয়ে) শুরুর দিকে দু’বছর পালমেরাসের ফুটসাল দলে খেলেছিলাম। পরে পালমেরাসের দ্বিতীয় দলে পেশাদার ফুটবল খেলার সুযোগ পাই। তবে ফুটবলার নয়, কোচিং করানোর দিকে বেশি আগ্রহ ছিল আমার। তাই বছর পাঁচেকের মধ্যে ক্লাব-টাব ছেড়ে সাও পাওলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই। ফুটবল নিয়ে মাস্টার্সও করেছি। কলেজে অবশ্য দু’টো ট্রফি জিতেছিলাম ফুটবলার হিসেবেই। (তখনই পাশের টেবিল থেকে দু’জন লাল-হলুদ সমর্থক ছুটে এলেন। ফালোপার অটোগ্রাফ নিলেন, ছবিও তুললেন।)

পত্রিকা: বড় ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছে ভিতরে জাগেনি কখনও?
ফালোপা: ব্রাজিলের ঘরে ঘরে চাল-ডাল না থাকুক, ফুটবল আছে। ব্রাজিলকে সবাই ফুটবলার তৈরির কারখানা হিসেবেই চেনে। কিন্তু বাস্তবে ঠিকঠাক ট্রেনিং আর পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাবে প্রতি বছর যে কত হাজার হাজার প্রতিভা হেলায় নষ্ট হচ্ছে, তার ঠিকানা নেই। আমি আমার গোটা জীবন ইউথ ডেভলপমেন্টের কাজেই উৎসর্গ করে দিয়েছি। কলেজে অ্যাথলেটিক্সেও দক্ষতা ছিল আমার। ওখানেই আমার আনার সঙ্গে প্রথম আলাপ। ওর ইভেন্ট ছিল চারশো মিটার। আমার আটশো মিটার। আপনি আরও একটা কথা জানেন?

পত্রিকা: কী?
ফালোপা: পাওলো রোসি আমার তুতো ভাই হয়।

পত্রিকা: কী বলছেন?
ফালোপা: (চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমার কাকা (পাওলো রোসি-র বাবা) ইতালিতে চলে যায়। তার আগে ওদের পদবিও ফালোপা ছিল।

পত্রিকা: ব্রাজিল মানেই ফুটবল। আর ফুটবল মানেই পেলে...
ফালোপা: (নামটা শুনেই চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল) পেলের নামটা যখন নিলেন, তখন একটা গল্প বলি। আমার বয়স তখন তেরো কি চোদ্দো। সাও পাওলোর রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছু ক্ষণ পরে বাস তো এল। কিন্তু সেই বাস ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকল প্রায় দেড় ঘণ্টা।

পত্রিকা: কেন?
ফালোপা: উঠে দেখি সেখানে পেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন। পেলেকে দেখে আমার এক বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ে বাস আটকে দিল। আর ‘পেলে-পেলে’ বলে পায়ে লুটিয়ে পড়ল। কিছু ক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে যায় যে, পুলিশও ছুটে চলে আসে। তবে পেলে কতটা অমায়িক ভাবতে পারবেন না। ও পুলিশ অফিসারকে নেমে যেতে বলে। আর সারা রাস্তা আমাদের সঙ্গেই গল্প করতে করতে যায়। সে দিন একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে যাচ্ছিল পেলে।

পত্রিকা: অবিশ্বাস্য!
ফালোপা: ১৯৮৬-৮৭ তে ব্রাজিল মাস্টার্স দলের সহকারী কোচ থাকার সময় পেলে আমার কাছে ট্রেনিং-ও করেছে। ওই সময় পেলের ফিটনেস দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই আমি।

পত্রিকা: তা হলে আপনি পেলের ভক্ত? মারাদোনার নন?
ফালোপা: ব্রাজিলিয়ান বলে কি এই প্রশ্নটা করতেই হবে? আমি বহু দেশ ঘুরেছি। প্রত্যেক দেশেই কোনও না কোনও ভাবে এই প্রশ্নটা উঠে এসেছেই। দেখুন আমি তুলনায় যেতে চাই না। আমি মারাদোনার অন্ধ ভক্ত। ওর মতো ফুটবলার না কোনও দিন জন্মেছে, না জন্মাবে। মারাদোনার বিকল্প মারাদোনাই। তবে যদি সব দিক বিচার করা হয়, তা হলে আমি পেলেকে এগিয়ে রাখব। পেলের খেলা দেখার জন্য নাইজিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য স্থগিত রাখা হয়। ১৯৬৭ সালে লাগোসে হিংসার পথ ছেড়ে সবাই পেলের খেলা দেখতে ছুটে এসেছিল। একটা ফুটবলার যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে, এ রকম ঘটনা আর দেখা যাবে না।

পত্রিকা: নেইমারকে ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ বলা হচ্ছে। আপনি কতটা আশাবাদী?
ফালোপা: নেইমার বড় ফুটবলার কোনও সন্দেহ নেই। তবে কনফেড কাপে ব্রাজিলের সাফল্যে নেইমার একা নায়ক নয়। পওলিনহো, অস্কার, ফ্রেড, হাল্ক— এই মুহূর্তে যে ‘গ্রুপ অব ফুটবলার’ খেলছে ব্রাজিলে, সবাই অসাধারণ। নেইমারকে ছোট করছি না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, নেইমার নিজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে এক দিন মেসিকেও ছাড়িয়ে যাবে।

পত্রিকা: চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থার মধ্যে পরের বছর বিশ্বকাপ হচ্ছে ব্রাজিলে...
ফালোপা: (হাসি-খুশি মুখটা হঠাৎ যেন উধাও) একজন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে আমি চাইব বিশ্বকাপ হোক। কিন্তু ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি বলি, তা হলে ব্রাজিলে বিশ্বকাপ নয়, অবিলম্বে হাসপাতাল দরকার। স্কুল দরকার। মানুষ খেতে পারছে না। পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দ্রুত উন্নতি না হলে আরও দুর্দিন অপেক্ষা করছে ব্রাজিলের।

পত্রিকা: বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জেতার সম্ভাবনা কতটা?
ফালোপা: ব্রাজিলই জিতবে জোর দিয়ে বলছি না। তবে ২০০২-এর পরে এই ব্রাজিলকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার প্রচুর কারণ দেখতে পাচ্ছি।

পত্রিকা: যেমন?
ফালোপা: রোনাল্ডিনহো, রোনাল্ডো, রবের্তো কার্লোস, কাফু, রিভাল্ডো, এডমিলসন— ২০০২-এর দলে কাকে ছেড়ে কার নাম নেব। আমার স্বপ্নের দল। আমি নেইমারদের নতুন দলের সঙ্গে এগারো বছর আগের সেই ঐতিহাসিক দলের তুলনা করছি না। তবে কনফেড কাপে আমি অস্কার, ফ্রেড, পলিনহোদের প্রতিভা, স্কিল এবং ফুটবলের প্রতি নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ। ব্রাজিলের আরও তিনটে প্লাস পয়েন্ট আছে।
১) এক দশক পরে ফের ব্রাজিলের দায়িত্বে লুইস ফিলিপ স্কোলারি।
২) হোম অ্যাডভান্টেজ।
৩) তারুণ্য। ২০০২-এ ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছিল অভিজ্ঞতার জোরে। ২০১৪-তে স্কোলারির বাজি তারুণ্য।

পত্রিকা: অ্যালেক্স ফার্গুসন থেকে শুরু করে পেপ গুয়ার্দিওলা, আর্সেন ওয়েঙ্গার কিংবা ত্রাপাতোনি— বেশির ভাগ সময়ই এঁরা নিজের দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন মাঠের বাইরে থেকে। আপনিও কি ইস্টবেঙ্গলে তাই করবেন?
ফালোপা: এ সব ভুল তথ্য কে দিল আপনাকে? স্কোলারিকে যেটুকু দেখেছি, উনি মাঠে নেমেই ফুটবলারদের সব মুভ দেখিয়ে দেন। কী ভাবে জায়গা নিতে হবে, কোথায় পাস করতে হবে, ফ্রিকিক নেওয়া, কর্নার সবই নিজে উদ্যোগ নিয়ে দেখিয়ে দেন। আমার কোচিংয়ের ধরনটাও অনেকটা সে রকমই।

পত্রিকা: আপনার কোচিং কেরিয়ারে তেমন কোনও বড় ট্রফি নেই...
ফালোপা: তাতে কী হয়েছে? ট্রফি নেই বলে, ট্রফি দিতে পারব না কোথাও লেখা আছে নাকি? এত দিন ইউথ ডেভলপমেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। ইস্টবেঙ্গলে প্রথমবার অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছি। নিশ্চিন্ত থাকুন, ট্রফি আসবেই।

পত্রিকা: ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের আমলে তিন বছরে মোট আটটি ট্রফি জিতেছে ইস্টবেঙ্গল। আপনাকে নিয়ে কিন্তু প্রত্যাশা আরও বেশি?
ফালোপা: জানি। সবার আগে আমি এএফসি কাপে মনোযোগ দিতে চাই। হাতে সময় নেই। কাজ বাকি অনেক। অন্তত দিন পনেরো লাগবে ফুটবলারদের মানসিকতা বুঝতে। তার পরে কে কোথায় খেলবে, কী ভাবে খেলবে, ঠিক করতে হবে।

পত্রিকা: ইস্টবেঙ্গলে আপনার প্রধান লক্ষ্য কী?
ফালোপা: আই লিগ। যে কোনও মূল্যে জিততে চাই।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.