মনোরঞ্জন...
লাল ঝুঁটিতে সোনার মুকুট
ম্পূর্ণ বদলে যাওয়া টলিউডেও পুরনো সেই দিনের কথায় মুখর বাংলার চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত জগতের নবীন-প্রবীণেরা। ‘খোকা ৪২০’ বা ‘C/0 স্যার’-এর যুগেও কী ভাবে পঞ্চাশ বছর আগের এক সাদাকালো ছবি রঙিন হয়ে ফিরে আসে নামীদামি তারকাদের স্মৃতিতে? শিশুদের জন্য টলিউড তৈরি করেছিল ‘বাবলা, ‘লালু ভুলু’ বা ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’। কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল ‘বাদশা’।
মেলায় হারিয়ে যাওয়া এক নিষ্পাপ শিশুর বাৎসল্যের রসে বদলে যাওয়া এক ডাকাতের কাহিনি নিয়েই অগ্রদূত তৈরি করেছিল ‘বাদশা’।
‘‘পশুদের নিয়ে নতুন আঙ্গিকের ছবি ‘বাদশা’-কে সেই সময়ে মানুষ খুব অ্যাকসেপ্ট করেছিল। গল্প-গান সব মিলিয়ে যে ধরনের বাংলা ছবি তখন হত, এখন আর তা এক্সপেক্ট করা যায় না,” দূরভাষে জানালেন বর্ষীয়ান শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।
সেই ছবির শিল্পী থেকে শুরু করে পরিচালক, সুরকার থেকে গীতিকার, প্রায় কেউই আজ আর ইহলোকে নেই। ব্যতিক্রম সেই ছবির শিশুশিল্পী মাস্টার শঙ্কর।
তাঁর লেক টাউনের বাড়িতে বসে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডা. শঙ্কর ঘোষ যখন বারবার ফিরে যাচ্ছেন ফেলে আসা দিনে, তখন মনে হচ্ছিল এ যেন কালকের কথা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন না, “ছোটবেলার কথা কখনও ভোলা যায় না।”
উজ্জ্বলা-উত্তরা-পূরবী সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার পরে টানা ১৭ সপ্তাহ চলেছিল ‘বাদশা’। ছবি ভাঙার পরে দর্শকেরা বেরিয়ে আসতেন চোখ মুছতে মুছতে। “এ দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভাসে। অভিনয় করতে করতে আবেগে কী অনায়াসে সন্ধ্যারানির মতো শিল্পী কেঁদে ফেলতেন, না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না,” শঙ্করবাবুর চোখে মুগ্ধতার রেশ।
ডাকাত বাদশার ভূমিকায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার পালিত সন্তান বাচ্চুর ভূমিকায় মাস্টার শঙ্করের অভিনয় ছিল এ ছবির সম্পদ। আর ছবির ইউএসপি ছিল তিনটি পশুর অনবদ্য সহযোগিতা। সবাই জানে, কুকুরের পিঠে বাঁদর কখনও বসতে চাইবে না। “কিন্তু এই কঠিন কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন পরিচালক বিভূতি লাহা। তার জন্য কত শট যে নষ্ট হয়েছিল।” অ্যালসেসিয়ান ল্যাসিকে সে সময়ে বাংলা ছবিতে প্রায়ই ব্যবহার করা হত।
‘বাদশা’ ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাঃ শঙ্কর
জীবনের শুরুতেই বড় সাফল্য পেয়ে যাওয়ায় একের পর এক ছবিতে ডাক পেয়েছিলেন শঙ্করবাবু। “উত্তমবাবুর সঙ্গে ‘নতুন তীর্থ’ এবং ‘স্ত্রী’ ছবিতে অভিনয় করেছি। দিনের শেষে সবার সঙ্গে বসে জমিয়ে তুলতেন কত সান্ধ্য আসর”।
‘বাদশা’ ছবির সাফল্যের পিছনে ছিল হেমন্তবাবুর সুরারোপিত গান। যে গানের সুর আজও বাংলার আকাশে বাতাসে ঘুরেফিরে বেড়ায়। ‘‘খুদে গায়কদের গান করতে বললে এখনও অনেকেই ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ গেয়ে ওঠে, জানালেন ইন্দ্রাণী সেন। ছোটবেলায় দেখা ‘বাদশা’ ছবির স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল তাঁর মনে। “পুরো পরিবার বসে দেখতে পারে এ ছবি।” ইন্দ্রাণীর আক্ষেপ, ‘বরফি’ বা ‘কহানি’র মতো সব ধরনের দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার মতো ছবি বাংলায় এখন আর প্রায় তৈরি হয় না। “খোকা ৪২০’ তো আর সবাই দেখতে যাবেন না। ”
‘বাদশা’য় মেয়ে রানুকে দিয়ে ‘শোন শোন শোন মজার কথা ভাই, সবার তো মা আছে আমার কেন নাই’ গাইয়েছিলেন হেমন্ত। এই গানও বহু বছর ধরে শ্রোতাদের মুখেমুখে ফিরত। গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
“এই ছবির গান সব অমর। এখনও নতুন। আসলে হেমন্তদা তো ‘জিনিয়াস’ ছিলেন। সিচ্যুয়েশন বুঝে ছবির গান তৈরি করতে তাঁর জবাব ছিল না”। যেমন ‘বাদশা’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, বা ‘দাদার কীর্তি’।” হেমন্ত-বন্দনায় মুখর সুরকার গায়ক জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
‘‘আমার দিদি চুল বাঁধতে না-চাইলে আমার মা ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ গেয়ে তার চুল বেঁধে দিতেন,” বলার পরেই এই গানের মুখড়া সুর করে গেয়ে ওঠেন বাবুল-সুপ্রিয়।
সতেরো সপ্তাহের পরে দ্বিতীয় বারের জন্য ‘বাদশা’ ফের ফিরে এল আলোছায়া, সুরশ্রী, রূপম আর আলেয়া-য়। বেলেঘাটার দেশবন্ধু হাইস্কুলের হেড স্যার সব ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে আলোছায়া হলে গিয়েছিলেন ‘বাদশা’ দেখতে। ওই স্কুলের ছাত্র শঙ্করের অভিনয় দেখে শিক্ষক থেকে ছাত্র কারও চোখ সে দিন শুকনো ছিল না। “আজ আর এমন কাণ্ড সম্ভব?” প্রশ্ন করেন শঙ্করবাবু।
বাঙ্গুর হাসপাতালের পিছনে ছিল রাধা ফিল্মস স্টুডিও। বাদশা ছবির প্রথম দিনের শু্যটিং শঙ্করবাবু ভোলেন কী করে! “বিকাশ রায়ের সঙ্গে শু্যটিংয়ের পরে আমার অভিনয় দেখে বিকাশবাবু এবং পরিচালক আমাকে তুলে শূন্যে ঘুরপাক খেয়েছিলেন।”
টলিউডের হট পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় শৈশবে ‘বাদশা’ দেখলেও মনে করতে পারলেন না ছবির কাহিনি। তবে ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ গানটি তাঁর মনে আছে।
পঞ্চাশ বছর আগের ছবির কথা মনে করে উচ্ছ্বসিত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। “আমার খুব ভাল লেগেছিল। যেমন কাহিনি, তেমনই গানের অনবদ্য কথা আর অসম্ভব মেলোডিয়াস সুর। এমন ছবি এখন আর হবে না।”
পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাবুল সুপ্রিয় আক্ষেপ করেন, একটা অবান্তর আইনের জোরে পশুপাখি নিয়ে আর ছবি হয় না। “আজকের বাচ্চাদের আমরা বঞ্চিত করছি। ‘বাদশা’, ‘হাতি মেরে সাথী’, ‘সফেদ হাতি’, ‘মা’ কী দুরন্ত সব ছবি আমরা দেখেছি।”
নিয়মিত সিরিয়ালে অভিনয় করলেও নতুন বাংলা ছবি দেখা হয়ে ওঠে না সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের। টিভি-তে পুরনো ছবিই দেখেন। “তখনও চলেছিল, এখনও ‘বাদশা’ টিভি-তে দেখালে বাবা-মা-ঠাকুরমা শুদ্ধ এই প্রজন্মও বসে দেখে।” আর নিজে দেখেন ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ বা ‘নিশিপদ্ম’, শট দিতে যাওয়ার আগে অকপট স্বীকারোক্তি বাংলা ছবির অন্যতম সেরা অভিনেত্রীর।
পুরনো সাদাকালো বাংলা ছবির ফটোগ্রাফির প্রশংসায় পঞ্চমুখ পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। “এখনও কী ঝকঝকে। ‘বাদশা’ ছবির কাহিনিও তো দারুণ ‘ইন্টারেস্টিং’। এমন কাহিনি নিয়ে ছবি করা এখন আর সম্ভব নয়। এখন তো ছবি তৈরি হয় সময় বা পরিস্থিতি অনুযায়ী।” জীবজন্তু নিয়ে বাংলায় শেষ ছবি ‘রাজা রানি বাদশা’ তিনিই তৈরি করেছিলেন।
তবে জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আশাবাদী। “আজকের অর্কেস্ট্রা বদলে গিয়েছে। ২৫-৩০ বছর পরে আমাদের গানও থাকবে।”
শ্রোতারা শুনছেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.