মুখোমুখি ১...
বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মধ্যে একটা কর্ণ সিন্ড্রোম আছে

পত্রিকা: ‘সিনেমার মতো’-র শুরুতেই যে ক্রেডিট লিস্ট ভেসে ওঠে, তাতে আসল নামটাই মিসিং।
ব্রাত্য: সেটা আবার কার (রীতিমতো বিস্মিত)?

পত্রিকা: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের!
ব্রাত্য: (আরও বিস্মিত) মমতা এখানে যুক্ত নেই তো! ওঁর নাম থাকবে কোথা থেকে?

পত্রিকা: আরে, বকলমে ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসর তো উনি। আপনার নাটকটা পুরো মমতা মডেল। ওঁর নির্বাচনী পাটিগণিত মেনে।
ব্রাত্য: বুঝলাম না। কী বলতে চাইছেন? (কিছুটা বিরক্ত)

পত্রিকা: এটা তো পুরোপুরি মমতা দর্শন। ‘নিশ’ অডিয়েন্সের পরোয়া না করে অঙ্ককে গুরুত্ব দেওয়া। সংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া। মডেলটা নিশ্চয়ই রাজনীতিতে এসে আরও ভাল বুঝলেন।
ব্রাত্য: ‘নিশ’ দর্শকের জন্য বানাইনি তো। একটা বিশ্বাস থেকে বানিয়েছি যে ভাল থিয়েটার সব সময় লোকে দেখে। এই পাটিগণিত-টনিত আপনি কী সব বললেন, অত তারা বোঝে না। ভাল কাজ বোঝে। ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’-য়ে একটা ম্যাজিক কাজ করেছিল। তখন কিন্তু রাজনীতিতে আসিনি।

পত্রিকা: তা-ও ‘সিনেমার মতো’ যে অর্থে বক্স-অফিসধর্মী, ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-কে ততটা গ্যালারির কথা ভেবে বানানো হয়নি।
ব্রাত্য: থিয়েটারের সেই পসিবিলিটি আছে। সেই ক্ষমতা আছে জনমত নির্বিশেষে অ্যাপিল করার। তাকে ‘নিশ’য়ে কেন আটকে রাখব? এমন কাজ হবে যে গোটা ক্রাউডটা আসবে। নিশ আসবে। আমজনতাও থাকবে।

পত্রিকা: আপনার নতুন নাটকের যা বাহার আর প্যাকেজিং, তা অবশ্যই বিদ্বজ্জনের জন্য নয়।
ব্রাত্য: বিদ্বজ্জনের জন্য নাটক অনেক হয়েছে। আর না-ই বা বাড়ল।

পত্রিকা: অ্যাকাডেমিতে ফিসফাস। মিডিয়ায় জল্পনা। কারও কারও বক্তব্য, ‘থানা থেকে আসছি’ হল নিখাদ থিয়েটার। ‘সিনেমার মতো’ থিয়েটারের হয়ে বিবৃতি।
ব্রাত্য: ‘থানা থেকে আসছি’ দেখিনি। কী করে বলব?
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
পত্রিকা: ‘সিনেমার মতো’ যে ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে নাট্যকার কোথাও থিয়েটারের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরেছেন ফিল্মকে। যারা নাটকের লোকজনকে বরাবর করুণাই করে এসেছে।
ব্রাত্য: একদম ঠিক। আমি চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছি। ফিল্মে যখন থিয়েটারের ছবি দেখায়, কেমন একটা ভগ্ন, অসহায়, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির মতো করে দেখায়। যেন তার সম্পদ নেই। আভিজাত্য নেই। রং থাকার অধিকার নেই।
আমার তো মনে হয় সারা পৃথিবীতে এখন ফিল্মের যা অবস্থা, থিয়েটারেরই তাকে করুণা দেখানোর কথা।


পত্রিকা: বিকাশ ভবনে উর্দিসান্ত্রি আর লাল আলোর মধ্যেও তা হলে ব্রাত্য বসু আদতে একজন রাগী নাট্যকর্মী। হীনমন্যতার অবস্থান সম্পর্কে যিনি ভয়ানক অ্যাংগ্রি। যাঁর ব্লাড গ্রুপে এখনও নাটক!
ব্রাত্য: দোষ বা রাগ নেই। বাংলা থিয়েটারের অবস্থান নিয়ে আছে অ্যাঙ্গুইশ। চাপা দুঃখ। আর বিকাশ ভবন যেটা বললেন, তার উত্তরে বলি, যখন আমি ঘুমোই তখনও যদি স্বপ্নে থিয়েটার থাকে। যখন আমি সিগারেট ধরাই, তখনও যদি থিয়েটার থাকে। যখন শুতে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করি, তখনও যদি থিয়েটার থাকে। তাহলে আলো আর সান্ত্রি-র মধ্যেও থিয়েটারই থাকবে।

পত্রিকা: প্রথম শো মঞ্চস্থ হয়েছে এক মাসের বেশি। এখন কি অনেক হাল্কা?
ব্রাত্য: হাল্কা লাগছে আর্তনাদটা ঝেড়ে ফেলতে পেরে। এত লোক দেখছে, ভাল বলছে। আর তো আর্তনাদ থাকল না। আর্তনাদ পরিণত হল থিয়েটারের জয়ের উল্লাসে!

পত্রিকা: কোথাও মনে হয়েছে এই নাটকটা যে ভেবেছে, যে লিখেছে, সে কিছু সংলাপ অনুচ্চারিত রেখেছে। অথচ সংলাপগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রাত্য: যেমন?

পত্রিকা: যেমন সুমন শোন্, আমি তোর সঙ্গে কাগজের পাতায় ঝগড়াঝাঁটি করতে চাই না। কৌশিক শোন্, আমি তোর সঙ্গে কার শো বেশি ভাল চলছে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে চাই না। আমি আমাদের সবার হয়ে একটা লড়াইতে নেমেছি।
ব্রাত্য: উ উ উ উ...এ সবের মূল্যায়ন একদিন ঘুমের মধ্যে হবে। আমাদের মৃত্যুর পর হবে। সমকালীন থিয়েটারের রাজদণ্ড কার হাতে ছিল সেটা সময় বলবে। ইতিহাস বিচার করবে।

পত্রিকা: ‘সিনেমার মতো’ টিকিটের দাম দু’শো টাকা। এটাও তো সদর্পে দাম্ভিক ঘোষণা, যে দ্যাখ, বাংলা সিনেমা দ্যাখ।
ব্রাত্য: আমি তো টিকিটের দাম তিনশো করতে চেয়েছিলাম। দলের সবাই হা হা করে আটকালো। আমি তো চাইব একদিন এমন হবে যে, বাংলা নাটক টিকিট করবে পাঁচশো টাকার।

পত্রিকা: ‘রাজা লিয়র’-এর আবার শো হলে কি পাঁচশো টাকার টিকিট করা যেতে পারে!
ব্রাত্য: আমি নাটকটা দেখিনি। কোনও মন্তব্য করব না। তা ছাড়া আমি আর বিতর্কে যেতে রাজি নই। আপনি আবার আমায় সেই গলিতে নিয়ে ফেলছেন।

পত্রিকা: নতুন অভিব্যক্তি পাওয়া গেল আপনার নাটকে। ‘সেঁকা পাঁউরুটি’।
ব্রাত্য: হাঃ হাঃ, ‘সেঁকা পাঁউরুটি’। অনেক ইন্টেলেকচুয়ালকে আমার দেখে মনে হয় সেঁকা পাঁউরুটির মতোই মিয়ানো, ভিতু ভিতু মার্কা।

পত্রিকা: আরও একটা সংলাপ আছে। তাতে প্রবল হাততালিও পড়ে ভাই তুই কি তৃণমূল? স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী লিখছেন বিস্ময়কর তো?
ব্রাত্য: অনিবার্য। চরিত্রটার ধরনই তো এ রকম। সে যে সময়টার কথা বলে তখন ক্ল্যাসিসিজমের পতন ঘটেছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাঙন যখন থেকে রাজনীতিতে শুরু হল, যখন থেকে পরিবর্তনের সূচনা সেই সময়ের কথা তো তৃণমূলীয় মননই বলে।
আমি যখন থিয়েটারের প্ল্যানিং করি, যখন লিখি তখন তো মন্ত্রী পরিচয় বহন করি না। নাট্যকার হিসেবে করি। আর একটা কথা বলি। আমি তাদের জন্যই মন্ত্রী, যারা আমার বিরোধী এবং অপমানসূচক কথাবার্তা বলে। বাকিদের জন্য আমি বন্ধু। বা স্বাভাবিক একজন মানুষ।


পত্রিকা: ‘সিনেমার মতো’ যে বক্স অফিসে কাটছে। দু’শো টাকার টিকিটের জন্য লোকে লাইনে দাঁড়াচ্ছে, নিশ্চয়ই একটা পাশবিক তৃপ্তি আছে?
ব্রাত্য: চার বছর পর থিয়েটার করলাম। মনের মধ্যে তীব্র একটা সংশয় তো ছিলই যে, আমি কি আর থিয়েটার করতে পারব! দর্শক নতুন করে নেবে তো আমাকে? সে দিক থেকে উল্লাস আছে। তৃপ্তি আছে। পাশবিকতা নেই।

পত্রিকা: এটাও কি তৃপ্তি যে, সংস্কৃতির দরবারের অদৃশ্য বর্ণাশ্রম সব সময় শম্ভু মিত্রের আগে উত্তম। শিশির ভাদুড়ির আগে সৌমিত্র। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রথম রেজিস্ট্রেশন হল?
ব্রাত্য: সেই প্রতিবাদটা ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ আর ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ দিয়েও করতে চেয়েছি। এর পরেও করে যাব। তাড়া করে যাব এই বিভাজনকে। চেষ্টা করে যাব যাতে বাংলা সিনেমা আর বাংলা থিয়েটার একই অভিজাত সরণিতে বসতে পারে। যাতে থিয়েটারকে ফিল্ম অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ না পায়।

পত্রিকা: অথচ সেই প্রতিবাদ করতে গিয়ে সিনেমার জনপ্রিয় গান আর মন্তাজই ব্যবহার করেছেন। এটা তো দ্বিচারিতা?
ব্রাত্য: দ্বিচারিতা কেন? থিয়েটারের উপাদানও তো সিনেমা হরবখত ব্যবহার করে। এর মধ্যে দোষ কোথায়?

পত্রিকা: এত যে ফর্ম ভাঙলেন এ বার, নাট্যসমাজের প্রতিক্রিয়া কী?
ব্রাত্য: তথাকথিত ‘নিশ’ অংশ কী প্রতিক্রিয়া জানাল, আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমার বন্ধুরা খুব ভালবেসেছে আর অনেক শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

পত্রিকা: অনেকের মধ্যে কিন্তু নতুন ফরম্যাট নিয়ে বিভ্রান্তিও। বিশুদ্ধ নাট্যপ্রেমীদের কারও কারও মনে হয়েছে ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ বোধহয় বেটার ছিল!
ব্রাত্য: বাঙালি বুদ্ধিজীবীর বিচার পদ্ধতি সব সময় কারেন্ট কাজের চেয়ে তার আগের কাজটাকে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে দেখেছে। আবার সেই কাজটা যখন কারেন্ট ছিল, তখন তার আগের কাজটাকে বলেছে শ্রেষ্ঠ। ঐতিহাসিক ভাবেই এটা করে এসেছে। তার ওপর কাজটা যদি জনপ্রিয় হয়, সেটা তাদের কাছে মহাপাতক যোগ। বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মধ্যে একটা কর্ণ সিন্ড্রোম আছে। এখুনি জিতলাম এটা বিশ্বাস না করে তারা অতীতের রোম্যান্টিক হার ধরে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়ায় বিশ্বাসী।
‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’য়ে একটা লাইন আছে না, আমি রব নিষ্ফল হতাশের দলে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.