|
|
|
|
|
|
বিপদের বন্ধু |
হাত বাড়ালেই... |
শ্রীজীব মুখোপাধ্যায় |
ব্যস্ত রাস্তায় শুয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন এক জন। ভ্রুক্ষেপহীন জনস্রোত চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। অবশেষে যখন সাহায্যের হাত এগিয়ে এল, তত ক্ষণে বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। শহরের এই অমানবিক মুখ সকলেরই চেনা। রোজকার ইভটিজিং, পথ দুর্ঘটনা, ছোট-বড় নানা অঘটনে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে অন্য মানুষের এসে দাঁড়ানোর ঘটনা বড় বিরল। কিন্তু, এর মধ্যেও ব্যতিক্রমী চরিত্র আছেন বইকী। তাঁদেরই এক জন কে বালাজি।
সাঁতরাগাছিতে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কার্পেন্ট্রি বিভাগের কর্মী বছর পঞ্চাশের বালাজি। নেহাতই ছাপোষা আর পাঁচ জনের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য একটাই, কেউ বিপদে পড়লে তিনি সাহায্যের জন্য ছুটে যান। দায় এড়িয়ে যান না। সাঁতরাগাছিতে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের অতিরিক্ত চিফ মেডিক্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট (সিএমএস) অর্ণব দাসের কথায়: “সাধারণত যে সমস্ত পরিস্থিতিতে অন্যেরা দায় এড়ান সেখানে বালাজি এগিয়ে যান। এখানেই উনি ব্যতিক্রমী।”
কীসের তাগিদে এই এগিয়ে যাওয়া?
|
|
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
|
বালাজির কথায়: “অনেক বছর আগে একটি বাচ্চা ট্রেন থেকে পড়ে আহত হয়। ওইটুকু শিশুকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে থাকতে পারিনি। হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেই শুরু। এখনও কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখলে সেই একই তাগিদ অনুভব করি।” রেললাইনে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। সাঁতরাগাছির সিনিয়র ডিভিশনাল মেডিক্যাল অফিসার দীপা চোধুরীর কথায়: “এই স্টেশনে প্রতি মাসে ২৫-৩০টা দুর্ঘটনা ঘটে। গত কুড়ি বছর ধরে বালাজিকে দেখছি নিঃস্বার্থ ভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। দুর্ঘটনা ঘটলে আমরাও তাঁর সাহায্য নিই। অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করা থেকে দুর্ঘটনাগ্রস্তের বাড়িতে খবর দেওয়া সবই তিনি করেন। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার সময়েও উদ্ধারকাজে তিনি প্রচুর সাহায্য করেছেন। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁকে পুরস্কৃত করার আবেদন জানিয়েছি।”
উদাহরণ আছে আরও। টিকিয়াপাড়া স্টেশনে এক বার এক ভিক্ষুকের দু’পায়েই ঘা হয়ে গিয়েছিল। দুর্গন্ধে যখন সবাই দূরে পালাচ্ছে তখন বালাজি তাঁকে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এক বার মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তি সাঁতরাগাছি স্টেশনের ইয়ার্ডের শেডের মাথায় উঠে পড়েন। পাশেই রেলের বৈদ্যুতিক লাইন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও বালাজি তাঁকে সেখান থেকে নামিয়ে আনেন। ট্রেনে কাটা পড়ার মতো দুর্ঘটনাতেও পুলিশের ঝামেলার তোয়াক্কা না করেই উদ্ধারকাজে নামেন। মৃতের বাড়িতে খবর দেওয়া থেকে মৃতদেহ তোলা সব ব্যবস্থা করেন। রেল দুর্ঘটনা ছাড়াও হাওড়া জেলা পুলিশেরও এক জন অপরিহার্য উদ্ধারকর্মী তিনি। জগাছা থানা থেকে প্রায়শই তাঁর ডাক পড়ে উদ্ধারকাজের জন্য।
রেল সূত্রের খবর, শুধু সাঁতরাগাছি নয়, হাওড়া থেকে খড়গপুরের মধ্যে যে কোনও রেল দুর্ঘটনায় ছুটে যান বালাজি। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সৌমিত্র মজুমদার বলেন, “কে বালাজি রেলের অসাধারণ কর্মী। জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার সময় তিনি অসাধারণ কাজ করেছেন।” আদতে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলার কে বালাজি দীর্ঘ দিন ধরে আছেন সাঁতরাগাছির কাছে মৌখালিতে। পরিবার বলতে স্ত্রী ও দুই ছেলে। দুই মেয়ে বিবাহিতা।
যখন-তখন বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই ছুটে যাওয়ায় পরিবারে কোনও অসন্তোষ তৈরি হয় না? বালাজির কথায়: “না। ওরা বরং উৎসাহই দেয়। এটা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কেউ বিপদে পড়েছে আর আমি যাব না, এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” |
|
|
|
|
|