ডেট্রয়েট দেউলিয়া। মাথায় পাহাড়-প্রমাণ (প্রায় ১,৮৫০ কোটি ডলার) ঋণের বোঝা। অথচ শুকিয়ে এসেছে রাজস্ব। বেকারত্ব বেড়েছে হু হু করে। মুখ থুবড়ে পড়েছে অধিকাংশ কল-কারখানা। কাজ নেই। তাই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছেন লক্ষ-লক্ষ মানুষ। অর্থনীতি এতটাই বিধ্বস্ত যে, টান পড়ছে পুলিশ, দমকল কর্মীদের বেতনে। টাকা নেই ধার মেটাবার। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন করে দৌড় শুরু করতে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করল ডেট্রয়েট শহর।
সেই ডেট্রয়েট, যেখানে গাড়ি শিল্পের প্রথম ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ পেতেছিলেন হেনরি ফোর্ড। জেনারেল মোটরস (জিএম), ক্রাইসলার, ফোর্ড মার্কিন গাড়ি শিল্পের প্রধান তিন গর্বের শিকড়ই যে শহরে। যেখানে গাড়ি আর তাতে যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী অজস্র সংস্থার কারখানায় কাজ খুঁজতে আসতেন হাজারে-হাজারে মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে শহরে তৈরি বিমান-ট্যাঙ্ক-অস্ত্রেই লড়াই করেছিল আমেরিকা। গত শতকে যার পরিচিতি ছিল বিশ্বের ‘গাড়ি-রাজধানী’ হিসেবে। সেই ডেট্রয়েট-ই বৃহস্পতিবার (মার্কিন সময় অনুযায়ী) বাধ্য হল দেউলিয়া আইনের ন’নম্বর ধারার আশ্রয় নিতে। যাতে পাওনাদারদের তাগাদা এড়িয়ে নজর দেওয়া যায় অর্থনীতি মেরামতির কাজে। |
আগেও দেউলিয়া ঘোষণার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে নিউ ইয়র্ক, ক্লিভল্যান্ড ও ফিলাডেলফিয়া। কিন্তু সরকারি ভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করা মার্কিন শহর হিসেবে ডেট্রয়েটই বৃহত্তম।
এই শহরের রমরমা বরাবরই ছিল উৎপাদন শিল্প (বিশেষত গাড়ি) কেন্দ্রিক। ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকার রাস্তার অর্ধেক গাড়ি ছিল শুধু জিএম-এরই। কিন্তু জাপানি গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে না-পেরে ক্রমশ পিছু হঠতে শুরু করে তার মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। এমনকী দীর্ঘ দিন ধুঁকতে থাকার পর ২০০৯ সালে দেউলিয়া ঘোষণা করতেও বাধ্য হয় জিএম এবং ক্রাইসলার। গাড়ি-শিল্প আর তার সঙ্গে যুক্ত কল-কারখানা ধসে যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে ডেট্রয়েটও। কমতে থাকে কাজের সুযোগ। তাই জনসংখ্যাও নেমে আসে ১৮ থেকে ৭ লক্ষে। কমতে থাকে কর আদায়ের অঙ্ক। বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা। প্রায় কোমায় চলে যায় অর্থনীতি। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় দুর্নীতিও।
শেষ দিকে পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন ছিল যে, পুলিশ, দমকল, পুরসভার কর্মীদের বেতন দেওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ধার করে চালাতে হচ্ছিল অবসর ভাতা। শহরের এক-তৃতীয়াংশ অ্যাম্বুলেন্স চলত না। জ্বলত না ৪০% রাস্তার আলো। খাঁ খাঁ করত বাড়িগুলো। খুন-খারাপিও হচ্ছিল গত ৪০ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে প্রথমে দেউলিয়া ঘোষণা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না, জানিয়েছে প্রশাসন।
২০০৯-এ দেউলিয়া ঘোষণার পর ঘুরে দাঁড়ানো জিএম-এর সদর দফতর এই ডেট্রয়েটেই। তাদের আশা, এ বার ফের নতুন করে দৌড় শুরু করবে ঐতিহ্যের এই শহর। একই আশায় বুক বেঁধেছে ফোর্ড-ও।
এক সময়ের মার্কিন গর্ব ফের জ্বলে উঠবে কি না, তার উত্তর অবশ্য দেবে সময়ই। |