দেশের আর্থিক সঙ্কটের কথা আজ অকপটে স্বীকার করে নিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। নির্দ্বিধায় জানালেন, বাজেটে চলতি আর্থিক বছরে সাড়ে ছয় শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা বলা হলেও, সেই আশা পূরণের সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। তবে একই সঙ্গে শিল্প ও বণিক মহলকে তাঁর আশ্বাস, অর্থনীতির সুদিন ফেরতে চেষ্টার কসুর করবে না তাঁর সরকার।
আজ বণিকসভা অ্যাসোচেমের বার্ষিক সাধারণ সভায় মনমোহনের এই স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়ে এক দিকে তাঁর বাস্তববাদিতা, অন্য দিকে বাজার তেজি করার চেষ্টা দেখছেন অনেকেই। সেই সঙ্গে মন্দার জন্য বিরোধীরা যে ভাবে সরকারকে দায়ী করছে, তার জবাবও আজ দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “রাজনৈতিক সমালোচকরা কেবল একটি খারাপ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই হইচই করছে। তাতে টিভিতে বিতর্ক জমতে পারে, কিন্তু সেই ছবিটা অসত্য।” এনডিএ এবং ইউপিএ জমানার বৃদ্ধির তুলনা টেনে বিরোধীদের সমালোচনার জবাব দেন তিনি।
অ্যাসোচ্যামের সভায় আলোচনার বিষয় ছিল: ‘২০১৪ সালের ইস্তাহার’। লোকসভা ভোটের দশ মাস আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “আমি জানি, অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে বণিকমহল উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রার বাজারের ওঠাপড়া এই মুহূর্তে আমাদের সব চেয়ে বেশি চিন্তায় রেখেছে। এই খারাপ সময়ে সরকারের দায়িত্বই সব বেশি এবং সরকারের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।” তবে মন্দার অনেকটাই যে আন্তর্জাতিক কারণে এবং সেই কারণগুলো যে তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই, তা-ও মনমোহন আজ মনে করিয়ে দিয়েছেন।
অর্থনীতির হাল ফেরাতে সরকার ইতিমধ্যেই কী ব্যবস্থা নিয়েছে, এবং ভবিষ্যতে আরও কী ব্যবস্থা নিতে চায়, তা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি খাতে ঘাটতি (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট) কমাতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতি সম্প্রতি প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির পথ যে প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছে, তার উল্লেখ করেন তিনি।
এই ক্ষেত্রে আরও সংস্কার এবং বৃদ্ধির হার বাড়াতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে জোর দেওয়ার আশ্বাস আজ মনমোহন দিয়েছেন।
কিন্তু এতে কাজের কাজ কতটা হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শিল্প মহলের অনেকেরই। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বেশ কিছু দিন আগে শরিক হারানোর ঝুঁকি নিয়েও প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দিয়েছিল কংগ্রেস। তার পরেও উল্লেখযোগ্য লগ্নি বলতে কিছু আসেনি। উল্টে গত মঙ্গলবার বিদেশি লগ্নির পথ আরও পরিষ্কার করে দেওয়ার দিনই কর্নাটক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ইস্পাত প্রকল্প বাতির সরার কথা ঘোষণা করেছে পস্কো। তার পরের দিনই ওড়িশায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ইস্পাত প্রকল্প থেকে সরে আসার কথা জানিয়ে দিয়েছে আর্সেলর-মিত্তল।
দু’দিনে ৮০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ হাতছাড়া হওয়া কেন্দ্রের পক্ষে বড় ধাক্কা। যা স্বীকার করে নিয়ে কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প মন্ত্রী প্রফুল্ল পটেল বলেছেন, “দুই সংস্থার এ ভাবে সরে দাঁড়ানো মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। এতে দেশ-বিদেশের শিল্পমহলের কাছে ভুল বার্তা যাবে। মনে হবে, শিল্প তৈরির পথে নিশ্চয়ই অনেক বাধা আছে এ দেশে।”
বস্তুত, লগ্নি টানার প্রাক্শর্ত হিসেবে অন্য বাধা সরানোর উপরেই জোর দিচ্ছে শিল্পমহল। তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং লাল ফিতের ফাঁসের শিকার হচ্ছে বহু প্রকল্প। ছাড়পত্র পেতে দেরির হওয়ায় ফিরে যাচ্ছে লগ্নির প্রস্তাব।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য আজ লগ্নির পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া সরল করার আশ্বাস দিয়েছেন। বিশেষ করে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দর এবং অমৃতসর থেকে কলকাতা পর্যন্ত শিল্প করিডর গড়ার বিষয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর এ দিনের বার্তাকে ইতিবাচক বলেই মনে করছেন শিল্পমহলের কর্তারা। অ্যাসোচেমের সভাপতি রাজকুমার ধুত বলেন, “মন্দা কাটাতে প্রধানমন্ত্র যে খুব চেষ্টা করছেন তা স্পষ্ট। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, অর্থনীতির এই দুর্দিনে তাঁর সরকার শিল্পমহলের সঙ্গেই রয়েছে।”
বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা বলেন, “এনডিএ জমানার সঙ্গে ইউপিএ জমানার তুলনা টানতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সততা দেখাচ্ছেন না। আসলে বর্তমান ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিকে আড়াল করার এটা একটা কৌশল।”
|