তৃতীয় দফার পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে যে দিন পারস্পরিক বিষোদ্গারের উত্তাপ, তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার থেকে সে দিন অমর্ত্য সেন শোনালেন, “প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, দেশের কতটা উন্নতি হয়েছে, তার সূচক তৈরি করে দিতে। প্রথম আলাপেই ওঁকে বলেছিলাম, আমি দক্ষিণপন্থী নই, আপনার ভোটার হলে আপনাকে ভোট দিতাম না। উনি বললেন, ক্ষতি নেই।”
শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর ‘দি আইডিয়া অফ জাস্টিস’ বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘নীতি ও ন্যায্যতা’ (আনন্দ) আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করতে আইসিসিআরে এসেছিলেন অমর্ত্য সেন। সেখানেই শ্রোতাদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরে এল ‘জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস’ প্রসঙ্গও। এক জন সরাসরি জানতে চাইলেন, পশ্চিমবঙ্গে আজ ম্যাকবেথের মতো ‘ফেয়ার ইজ ফাউল অ্যান্ড ফাউল ইজ ফেয়ার’ অবস্থা। ভাল এবং মন্দের বোধ কি গুলিয়ে গিয়েছে? অমর্ত্য জানিয়ে দেন, “এখনই এত সংক্ষেপে সে সব আলোচনা করা যাবে না।” |
গণতন্ত্রের কথা বললেন এক পড়ুয়ার প্রশ্নের উত্তরেও। ইংরেজিতে জঁ দ্রেজের সঙ্গে অমর্ত্যের সদ্যপ্রকাশিত ‘অ্যান আনসার্টন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইট্স কন্ট্রাডিকশন্স’ বইটির উদাহরণ টেনে প্রশ্ন ছিল, “এক দিকে ভারতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অথচ সার্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্যে আমরা পিছিয়ে। এটা কি গণতন্ত্রের ব্যর্থতা নয়?” অমর্ত্যের উত্তর, “অম্বেডকর বলেছিলেন, এডুকেট, অর্গানাইজ অ্যান্ড অ্যাজিটেট। আমরা যদি সেই শিক্ষাদান, সংগঠিত করার কাজই করে উঠতে না পারি, সেটি গণতন্ত্রের দোষ হবে কেন?” তার পরেই বললেন, “তাই নীতির অভাব আছে, বলা যায় না। বরং ন্যায্যতার অভাব।”
মাতৃভাষায় বই প্রকাশ করতে এসে রসবোধের অকুণ্ঠ দীপ্তিতে উজ্জ্বল অমর্ত্য। বললেন, “নোবেল প্রাইজ পাওয়া অর্থনীতিবিদরা কী আর ভুল করেন না? খুবই করেন। যেমন আমি।” পাশাপাশিই মন্তব্য, “এই সব বই যাঁরা পড়েন, কিছু দক্ষিণপন্থী। কেউ বামপন্থী। কেউ বা কোন পন্থী, নিজেরাই জানেন না।” সামনের সারিতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যান সুগত বসু, মঞ্চে উপাচার্য মালবিকা সরকার। হাল্কা সুরে ওই মেন্টর গ্রুপের উপদেষ্টা অমর্ত্য বলেন, “উপদেষ্টার ভূমিকাটা আমি পছন্দ করি, কাজটা করতে হয় অন্যদের। যেমন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে।”
অমর্ত্য সেন ইংরেজি, জার্মানের পাশাপাশি পালি ভাষাও জানেন। ফলে, তাঁর প্রেরণায় অনুবাদকেরাও শব্দচয়নে সাবধানী। বইয়ের নামেই তার প্রমাণ। ইংরেজিতে রলসের বইয়ের নাম ছিল ‘এ থিওরি অফ জাস্টিস’। অমর্ত্যর বই ছিল ‘দি আইডিয়া অফ জাস্টিস’। বাংলা অনুবাদে থিওরি, আইডিয়া কোনও শব্দই থাকল না। বাংলা শিরোনাম মূল নামটিকে অনুসরণ করেছে, অনুকরণ করেনি। দশ জন অনুবাদকের অনূদিত এই বই সম্পাদনায় অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও কুমার রাণা।
বইতেই আছে ‘নীতি শব্দটি ব্যবহার করা হয় যথোচিত প্রতিষ্ঠান বা যথাযথ আচরণের জন্য। আর ন্যায় বলতে সামগ্রিক ভাবে ন্যায্য পরিণাম।’ অমর্ত্য দেখিয়েছেন, কৌটিল্য বা ম্যাকিয়াভেলি তৈরি করেন নীতি। আর অশোক বা আকবর ন্যায়। অতএব ‘নীতি ও ন্যায্যতা’।
|