সকালে খাদ্য নিরাপত্তা বিল নিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, “ওটা এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি।” পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি এই বিলটি সম্বন্ধে খুব ভাল করে জানি না। তবে যত দূর জানি, এই বিলটি নিয়ে অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। সংসদে আলোচনা করে তা আনা হয়নি। এটা দুঃখজনক।”
আর সন্ধ্যাবেলায় নন্দনে জঁ দ্রেজ ও তাঁর নতুন বই ‘ইন্ডিয়া: অ্যান আনসার্ট্ন গ্লোরি’-র (অ্যালেন লেন, পেঙ্গুইন) আনুষ্ঠানিক প্রকাশে এসে তিনিই রসিকতা করলেন, “মিডিয়া আমাকে খাদ্য নিরাপত্তা বিলের পিতা বলছে। এ তো দেখি পিতৃত্বের মামলা!”
অমর্ত্য সেন কি আসলে দু’জন? সকালবেলায় ছিলেন অর্থনীতির তাত্ত্বিক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছরের দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতার শিরোনাম: ‘ফার্স্ট থিংস ফার্স্ট’। ‘সোশ্যাল চয়েস থিয়োরি’র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বোঝালেন ‘লেক্সিকোগ্রাফিক অর্ডারিং’ অভিধানে যে ভাবে শব্দ সাজানো থাকে তাতে কিছু ধরা যায় না। ধরা যাক, ক-এর উপর একটি কাজের দায়িত্ব। সে সিদ্ধান্ত নেবে, কিন্তু কাজটি করবে খ। কাজটি পণ্ড হলে কাকে দোষ দেওয়া হবে? ক, খ-র আড়ালে হয়তো লুকিয়ে আছে গ। সে-ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, খ কাজটি করবে। মডেল বুঝিয়ে দিল মোদ্দা কথা: পারস্পরিক দোষারোপে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনও এগোয় না। ইনিই এক নম্বর অমর্ত্য সেন। তাত্ত্বিক বিষয়ে গণিত-সমৃদ্ধ গবেষণা করে অর্থনীতির জগতে সাড়া ফেলে দেন। |
শহরে অমর্ত্য সেন। জঁ দ্রেজের সঙ্গে। সোমবার নন্দনে একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে। ছবি: সুদীপ আচার্য |
সন্ধ্যার নন্দনে তাত্ত্বিক নন, যেন এক নীতি-রচয়িতা। তাঁর ছাত্র কৌশিক বসুই তো একদা দুই অমর্ত্যকে আলাদা করে দিয়েছিলেন, “এক জন জটিল অর্থনৈতিক তত্ত্বের উদ্গাতা। অন্য জন দার্শনিক, নীতিনির্ধারক ও জনপ্রিয়।”
সাহস করে প্রশ্নটা করে ফেললাম। দুই অনুষ্ঠানের মাঝে একান্ত সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য হেসে বললেন, “না, না, অমর্ত্য সেন এক জনই।”
কিন্তু এই যে কখনও ‘আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ লিখে জানাচ্ছেন, প্রতিটি মানুষকে পরিচিতির বহুত্বকে সম্মান করতে হবে। কখনও ‘দি আইডিয়া অফ জাস্টিস’-এ লিখছেন, পরিপূর্ণ ন্যায়নিষ্ঠ পৃথিবী নিয়ে ভেবে লাভ নেই। অন্যায় কতটা কমানো যায়, সেটাই লক্ষ্য। ‘আনসার্ট্ন গ্লোরি’তে আবার অন্য প্রশ্ন। এত আর্থিক বৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন ভারতের অর্ধেক মানুষ পাবেন না শৌচাগারের সুযোগ? কেন এক-তৃতীয়াংশ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছবে না? এখানে তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ কোথায়?
“অর্থনীতির অঙ্ক নিশ্চয় উপভোগ করেছি, কিন্তু কোন সমস্যা নিয়ে কাজ করব, সেটা অর্থনীতির বাইরের চিন্তার উপরেই নির্ভর করেছে। গাণিতিক অর্থনীতিরও যে একটা মানবিক দিক আছে, সেটা তো ‘চয়েস অব টেকনিক্স’ (তাঁর প্রথম দিকের কাজ) থেকেই আমার মাথায় এসেছিল। ওখানে প্রথম পাতার প্রথম ফুটনোট তাই কার্ল মার্ক্স থেকে। দুটো পর্যায় আমি আলাদা ভাবে দেখি না।”
বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে তাঁর কথা থেকেই বেরিয়ে এলেন যেন আরও এক জন, তৃতীয় অমর্ত্য সেন। ভুল-বোঝায় নির্মিত অমর্ত্য। বললেন, “আমার সম্পর্কে সকলের ভুল ধারণা, আমি নাকি ভর্তুকির পক্ষে।” দ্রেজ ও সেনের সদ্য-প্রকাশিত বই জানিয়ে দেয়, এই ধারণা কতখানি ভুল। বিদ্যুৎ, সার, পেট্রোল, ডিজেল, নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার পক্ষে তাঁরা। ক্ষুরধার যুক্তিতে জানান, ওই ভর্তুকি শুধুই দেশের ২০% মধ্যবিত্তের জন্য। তারা কোটিপতি নয়, আবার দিন আনি-দিন খাই অবস্থাতেও নয়। তবু তারা নিজেদের ‘আম আদমি’ বলে।
ভুল বোঝাটা জোরদার হয়েছে আরও নানা কারণে। দ্রেজ ও সেনের বই বেরোনোর কয়েক মাস আগেই বেরিয়েছে জগদীশ ভগবতী ও অরবিন্দ পানাগারিয়ার ‘হোয়াই গ্রোথ ম্যাটার্স।’ সেখানে দুই লেখকের সওয়াল, সংস্কারকে আরও জোর গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। প্রথম ধাপের সংস্কারের পরই আসবে দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার। তখন আরও বেশি রাজস্ব উঠবে, সেই টাকা দারিদ্র দূরীকরণে ব্যবহার করা যাবে।
এখান থেকেই কেউ কেউ একটা লড়াই খুঁজে নিয়েছেন দ্রেজ-সেন বনাম ভগবতী-পানাগারিয়া! অথচ এ যুদ্ধ নিরর্থক। হার্ভার্ডের অধ্যাপক অমর্ত্য ভর্তুকি তুলে, খাদ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে তা খরচ করে সবাইকে নিয়ে সংস্কারের পথে এগোতে চান। ইনক্লুসিভ সংস্কার! কলম্বিয়ার অধ্যাপক ভগবতীও দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার চান দরিদ্রদের অবস্থা ফেরানোর জন্য। স্বভাবতই, কৌশিক বসুর মন্তব্য, “দু’জনে একই কথা বলেন, কিন্তু ভিন্ন ভাষায়।”
আর, ভিন্ন ভাষায় কথা বলাই যেন হার্ভার্ড বনাম কলম্বিয়ার এই লড়াইকে লোকসভা ভোটের আগে এক অন্য তাৎপর্য দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, অমর্ত্য যেন সনিয়া গাঁধী তথা ইউপিএ-র অর্থনৈতিক প্রবক্তা, জগদীশ ভগবতী যেন নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি-র। অমর্ত্যর হিসেব, খাদ্য নিরাপত্তা বিল ঠিক সময়ে পাশ না হওয়ার জন্য ফি সপ্তাহে প্রায় হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। ভগবতী, পানাগারিয়াদের বক্তব্য, “হিসেবটা কোথা থেকে পাওয়া গেল? জন্মানোর সময় কম ওজন, ঠিকঠাক সুষম খাবার না-পাওয়া, মায়ের অপুষ্টি, নানা কারণ থাকতে পারে।” কেরল-অভিজ্ঞতা নিয়েও তাঁরা ভিন্ন মত। অমর্ত্য জানান, কেরল শিক্ষায় এগিয়ে। ভগবতীরা পাল্টা বলেন, কেরল কোনও মডেল নয়। স্বাধীনতার আগেই সেখানে প্রাথমিক শিক্ষায় ভাল কাজ হয়েছিল। উন্নয়নের মডেল হতে পারে গুজরাত।
দু’জনের তর্কটা কোনও রাজনীতির লড়াই নয়, অর্থনৈতিক তত্ত্বের নিজস্ব তর্ক। যেমন, অমর্ত্য দারিদ্র উন্নয়নের যে সূচক (হিউম্যান রিসোর্স ইনডেক্স) মানেন, ভগবতী মানতে নারাজ, “সূচকটি পাতে দেওয়ার মতো নয়। ওর মধ্যে সাক্ষরতা ও নানা পরিমাপ রয়েছে।”
নন্দনে জঁ দ্রেজ ওই সূচকটি ধরেই দেখালেন, “কেরলই একমাত্র উদাহরণ নয়, হিমাচলপ্রদেশ, তামিলনাড়ু শিক্ষায় লগ্নির কাজ শুরু করে। এখন তারা এগিয়ে।” খাদ্য নিরাপত্তা ভাল, কিন্তু যে লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বাইরে পড়ে নষ্ট হয়? আমলাদের দুর্নীতি আর অক্ষমতাতেও তো অনেক খাদ্য নষ্ট হবে? দ্রেজ-সেনের নতুন বই জানায়, যথার্থ রাজনৈতিক সমর্থন, ঠিকঠাক বুদ্ধি-সহ কাজ করতে পারলে সেই সমস্যাও কাটানো যায়। যেমন, ছত্তীসগঢ়ে গণবণ্টন, ওড়িশায় পেনশন ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত।
প্রশ্ন সোনা বা হিরের আমদানি শুল্কে ছাড় নিয়েও। দ্রেজ-সেন দেখান, সোনা ও রত্নে চিদম্বরম যে বাড়তি আমদানি শুল্ক আরোপ করেছিলেন, সেটা থেকেই খাদ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় টাকা উঠে আসত। চিদম্বরম পরে মধ্যবিত্তদের চাপে শুল্কবৃদ্ধি ফিরিয়ে নেন। কিন্তু ওই শুল্ক থাকলে হিরের আমদানি এ দেশে কমত না? হিরে তো দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এনে এ দেশে পালিশ এবং জহুরির কাজ করা হয়। তার পর তা বিদেশের বাজারে চলে যায়। অমর্ত্যর উত্তর, “কমত, সেই কারণেই সরকারি হিসেব পুরোটা আমরা ধরিনি। আরও কনজার্ভেটিভ হিসেব করেই দেখানো হয়েছে, প্রয়োজনীয় টাকাটা উঠে আসত।” শুল্কের চাপে আমদানি কমে যাওয়ার হিসেব ধরা এখানেই তো প্রথম অমর্ত্য সেন। আর দ্বিতীয় অমর্ত্য সেন? তাঁর নতুন বই শুরু শেক্সপিয়রের ‘টু জেন্টলমেন অফ ভেরোনা’র সংলাপে: ‘দ্য আনসাটর্ন গ্লোরি অফ অ্যান এপ্রিল ডে।’ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা শুরু করেছিলেন ব্রেখটের ‘গালিলেও’-র সংলাপে, ‘দুর্ভাগা সে দেশ, যার নায়কের প্রয়োজন হয়।’
সমকালীন বাস্তব নায়কের কথা তুলে আনলেন সঞ্চালক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়। নন্দনে দুই লেখকের সঙ্গে আলোচনার সূত্রে তিনি প্রশ্ন তুললেন, মনমোহন সিংহ ইনক্লুসিভ গ্রোথ-এর কথা বলছেন, কিন্তু সরকার তো সে জন্য যথেষ্ট কাজ করতে পারেনি? অমর্ত্য সেনের জবাব “মনমোহন সিংহ আমার বন্ধু, কিন্তু এটা দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতেই হবে যে সরকার আরও অনেক কাজ করতে পারত। তবে সে জন্য সিনিকাল হয়ে কোনও লাভ নেই। অম্বেডকরের কথাটা আমাদের সকলেরই মনে রাখা দরকার। তিনি বলেছিলেন: এডুকেট, এনগেজ, অ্যাজিটেট।”
কাজটা তো কেবল নায়কের নয়, সকলের। |