আজ, শুক্রবার তৃতীয় দফার পঞ্চায়েত ভোটে শান্তিরক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসনের কর্তারা। চিন্তিত রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু কেন্দ্রের পাঠানো আরও ৬০ কোম্পানি জওয়ানকে আজ ভোটের কাজে লাগাতে নারাজ রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ওই জওয়ানদের এসে পৌঁছনোর কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মহাকরণের মত বদল না হলে তাঁদের সম্ভবত দুর্গাপুরেই রেখে দেওয়া হবে। রাজ্যের এই সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র।
পাঁচ দফার পঞ্চায়েত ভোটের কোন দফায় কত বাহিনী মোতায়েন করা হবে, তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কমিশন সূত্রে বলা হচ্ছে, তৃতীয় দফায় ২৫ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। সেই মতো কেন্দ্রের তরফে ২৫০ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী পাঠানো হলেও কমিশনের বক্তব্য, একটি কোম্পানিতে নিরাপত্তার কাজে মোতায়েন করার মতো জওয়ান থাকেন বড়জোর ৮০ জন। ফলে জওয়ানের মোট সংখ্যায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
তা ছাড়া, কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী, একটি বুথে চার জনের কম জওয়ান মোতায়েন করা যায় না। সেই কারণে অনেক জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা যাচ্ছে না। এই নিয়ম শিথিল করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নারাজ। ফলে সব মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হলে আরও কেন্দ্রীয় বাহিনী লাগবে বলে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিল কমিশন। কেন্দ্র তাদের যুক্তি মেনে এখন আরও ৬০ কোম্পানি বাহিনী পাঠালেও রাজ্যের পাল্টা বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে যথেষ্ট পরিমাণ বাহিনী ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে। এর অতিরিক্ত বাহিনীর আর দরকার নেই।
আজ, শুক্রবার পঞ্চায়েত ভোটের তৃতীয় দফায় উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হাওড়ায় ভোট। তার দু’দিন আগে থেকেই যে ভাবে রাজ্যের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও চিন্তিত। তাঁর সচিবালয় সূত্রেই এ খবর মিলেছে। এ দিন রাজ্য প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয়তা বাড়ানোর পক্ষে মুখ খুলেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। তিনি বলেন, “আধা- সামরিক বাহিনীকে বসিয়ে না-রেখে তাদের আরও সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাহিনীকে অনেক ভাগে বিভক্তও করে দেওয়া হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতে হিংসা-হানাহানি কমবে।” রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে আজ, রাজ্যপাল দিল্লি যাবেন।
প্রতি তিন মাস অন্তর রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে এমনিই দিল্লি যান রাজ্যপাল। কিন্তু ভোট এবং চলতি হিংসার আবহে এ বারের দিল্লি সফর আলাদা করে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভোটের মাঝে অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকেই দিল্লির মনোভাব খানিকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রাজ্য সেই বাহিনী কাজে না-লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, কেন্দ্রের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটাই এখন দেখার।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক কর্তা বলেন, রাজ্যে অশান্তির পিছনে অনেক সময়ই শাসক দলের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার না-করা এবং বাইকবাহিনী রোধে আদালতের নির্দেশ না-মানার অভিযোগও তাঁদের কানে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যপালের বৈঠকে এই বিষয়গুলি উঠতে পারে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের সঙ্গেও বৈঠক করবেন রাজ্যপাল।
তৃতীয় দফার ভোটে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন মহাকরণের কর্তারাও। তাঁরা বলছেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, উত্তর ২৪ পরগনার আমতলা অথবা বীরভূমে যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে শান্তিপূর্ণ ভোট করতে গেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতেই হবে।
কিন্তু রাজ্যে যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছে, তাকেও যথাযথ ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না বলেই কমিশনের অভিযোগ। খাতায়কলমে জেলা প্রশাসন এখন কমিশনের অধীনে হলেও বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কোনও খবরই জেলা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে কমিশন সূত্রের দাবি।
কমিশনের এক আধিকারিক এ দিন বলেন, গত ৯ জুলাই কমিশনের সচিব তাপস রায় রাজ্যকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, আরপিএফ জওয়ানদের এনে সল্টলেক স্টেডিয়ামে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁদের কাজে লাগানো হোক। কিন্তু তার পরেও ১১ তারিখ, দ্বিতীয় দফার ভোটে তা করা হয়নি।
কেন্দ্রের পাঠানো বাড়তি বাহিনী নিয়েও রাজ্য বেঁকে বসায় উদ্বিগ্ন কমিশনের কর্তারা। তাঁদের মতে, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর-১, ও ২ নম্বর ব্লক, বসিরহাট মহকুমা উত্তেজনাপ্রবণ।
এ দিনই উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর ও রাজারহাট-মহিষবাথান এলাকায় ঘুরে তা টের পাওয়া গিয়েছে। অশান্তির আশঙ্কায় বাসিন্দারাও। মহিষবাথান এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী টহল দিলেও ব্যারাকপুরে তাদের দেখা যায়নি।
ব্যারাকপুর এলাকার সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী রঞ্জিত কুণ্ডু অভিযোগ করেন, “তৃণমূল বহিরাগত এনে এলাকার দখল নিচ্ছে। বহিরাগতদের বিভিন্ন লজ ভাড়া করে রাখা হচ্ছে।” যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষের বক্তব্য, “বহিরাগত আনলে সিপিএম-ই আনবে।” বহিরাগতদের দিয়ে এলাকা দখলের অভিযোগ উঠেছে মহিষবাথানেও। সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক রবীন মণ্ডল বলেন, “মহিষবাথানে আমাদের প্রার্থীরা বাড়িছাড়া। তৃণমূল ওই এলাকায় সন্ত্রাস করছে।” যদিও তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের বক্তব্য, “সিপিএমের ভোট প্রচারের ভিডিও রেকর্ডিং রয়েছে। আর সন্ত্রাসের অভিযোগ ধোপেই টেকে না।”
স্পর্শকাতর এলাকা রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হাওড়াতেও। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-২ ভাঙড়, গোসাবা এবং কলকাতা-বাসন্তী রোডের দুই পাশের বিস্তীর্ণ
এলাকা অতি স্পর্শকাতর। হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর, উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইল, জগাছা, বালির পঞ্চায়েত এলাকা নিয়েও চিন্তায় রয়েছে কমিশন।
|