নিগ্রহের প্রতিবাদ করে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পাওয়া তরুণীও ভয় পান! অবাক করলেন সুনীতা মুর্মু।
রামপুরহাটের সরকারি হোম পুষ্পরাগ নিকেতনে বসা হলুদ-কমলা সালোয়ার কামিজ গত তিন বছরের মধ্যে সাবালক হয়েছেন। পুজো-উৎসব-অসুস্থতায় বাড়িতে যান। কাজ চালানো লেখাপড়া শিখেছেন। সেলাই-ফোঁড়াই শিখেছেন এত দূর, যে হোমে থাকার মেয়াদ ফুরনোর পরে (আগামী অগস্টে) রামপুরহাটে দোকান খুলে দিন চালানোর মতো আত্মবিশ্বাসেও ভরপুর। তাঁর-ও ভয়!
“গ্রামে আর ফিরব না। ওখানে থাকতে ভয় লাগে”, মাথা নিচু, চোখ আড়াল করেন এমনিতে উজ্জ্বল এই মুখ। এই মেয়েই একটু আগে কামদুনি, খোরজুনা-কাণ্ডকে এক সুতোয় গেঁথেছেন। বলছেন, “টিভিতে দেখেছি সব।
|
সুনীতা মুর্মু |
এই লোকগুলো সব জায়গাতে এক রকম। মেয়েদের সর্বনাশ করতে পারলে ওরা আর কিছু চায় না।”
‘সর্বনাশ’ কাকে বলে, হাড়েহাড়ে জানেন রামপুরহাট থানার আদিবাসী প্রধান বড়তলা গ্রামের এক সময়ের বাসিন্দা সুনীতা। ভিন্ জাতের এক যুবকের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় দেখা গিয়েছে, এই অভিযোগে ২০১০-এ সতেরো বছরের মেয়েকে বিবস্ত্র করে তিনটে গ্রামে ঘুরিয়েছিল জনতা। মেরেছিল লাঠির বাড়ি। টিটকিরি, কুকথা বলতে ছাড়েননি মহিলারাও। তার উপরে ছিল হুমকি-- ‘অত্যাচারের’ কথা পুলিশ-প্রশাসন পর্যন্ত গেলে সামাজিক বয়কট করা হবে, প্রাণও যেতে পারে।
তিন মাস পরে কোনও সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশই যায় বড়তলায়। একের পর এক অভিযুক্তকে চিনিয়ে দেন সুনীতা। তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা ও শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ হয় ১২ জনের বিরুদ্ধে। ২০১১-র জুলাইতে সিআইডি ওই মামলায় চার্জশিট (মোট অভিযুক্ত ১৬) দেওয়ার আগেই ধরা পড়ে আট জন। আট জন পলাতকের মধ্যে সম্প্রতি ধরা পড়েছে আরও দু’জন। এখনও ভয় কীসের?
“এলাকাটা তো বদলায়নি”, দাবি তরুণীর। তাই কি? মহকুমাশাসক (রামপুরহাট) রত্নেশ্বর রায় বলেন, “ওই এলাকায় সচেতনতা-প্রচার হয় নিয়মিত। এটাও ঠিক, প্রচারে সব সময় প্রত্যাশিত গতি থাকে না।”
সুনীতা-পর্বে কী হয়েছিল? বড়তলা গ্রামের ছেলে-বুড়ো-জোয়ান-বৃদ্ধা হয় বলেছেন, “আমি এ গ্রামের কুটুম”, না হলে “তখন কুটুমবাড়ি ছিলাম, কিচ্ছু জানি না।” গ্রামের বাড়িতে সুনীতার ক্রাশার-কর্মী দাদা গুপিন, বৌদি রানির মুখে কুলুপ। আশপাশে কৌতূহলী চোখের ভিড়ের জন্যই কি? জবাব আসে না। তবে সুনীতার পড়শি এক দশম শ্রেণির ছাত্রী আর অন্যত্র বিয়ে হওয়া গ্রামেরই এক যুবতী নাম না লেখার শর্তে বলেন, “গ্রাম বদলায়নি।”
বড়তলা থেকে বড়জোর আধ কিলোমিটার দূরে দেখা স্কুলের পোশাকে দুই ছাত্রীর সঙ্গে। মাসড়া পঞ্চায়েতেরই ধরমপুরে বাড়ি। জানাল, সাইকেলে রোজ বাড়ি থেকে মিনিট পনেরো দূরের মলুটিতে প্রাইভেট টিউশন নিতে যায়। তবে দিনের আলো থাকতে। “অন্ধকারে মেয়েদের চলা মুশকিল”, অকপট দুই দশম শ্রেণি। একটু দূরে শালবাদড়ার ক্রাশার এলাকায় ব্যস্ত মাসড়া পঞ্চায়েতের তেতুলবাঁধি, বাঁধপাড়া গ্রামের একাধিক মহিলা-শ্রমিকদের ক্ষোভ, “সর্বত্র আলাদা শৌচাগারের প্রতিশ্রুতি (মালিক পক্ষের অবশ্য দাবি, সর্বত্রই আলাদা শৌচাগার হয়েছে) থাকলেও বাস্তব অন্য রকম।” শৌচকর্ম সারতে স্টোনচিপের ঢিপি বা ট্রাকের সারির আড়ালই ভরসা তাঁদের অনেকের। সম্মানহানির ভয়ও নিত্যসঙ্গী।
তবে এলাকা না বদলানোর এই ‘তত্ত্ব’ খারিজ করছেন মঙ্গল বাস্কে। সুনীতার প্রাক্তন বাসস্থান মাসড়া পঞ্চায়েতের বিদায়ী সিপিএম প্রধান এ বার ওই এলাকা থেকে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী। থাকেন সুনীতার বাড়ি থেকে বড়জোর তিরিশ কদম দূরে। বলছেন, “পরিবেশ ঠিক হয়ে গিয়েছে। এলাকাবাসীকে বুঝিয়েছি, মেয়েটার (সুনীতা) উপরে অত্যাচার করা ঠিক হয়নি।” “এলাকায় মেয়েদের উপরে অত্যাচারের মাত্রা কমেছে”, দাবি করেছেন সুনীতার এলাকায় পঞ্চায়েতে এ বারের তৃণমূল প্রার্থী বাবুলাল মুর্মুও। রাজনৈতিক নেতা-প্রার্থীদের কথাতে ইঙ্গিত, ভোটের আগে মেয়ে-মহিলাদের সমস্যার চেয়ে রাস্তা, সেচ, বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা পাওয়া-না পাওয়ার মতো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে বেশি আগ্রহী তাঁরা।
কী বদল চেয়েছিলেন? “মেয়েদের যাতে কেউ না জ্বালায়। সর্বনাশ হলেও যাতে মেয়েরা তা নিয়ে মুখ খুলতে পারে। খারাপ কাজের মামলাগুলো আদালতে দ্রুত মেটে। খারাপ লোকগুলো গারদের বাইরে না থাকে,” কথাগুলো বলে ফের চুপ সুনীতা।
আঙুল ছুঁয়ে যায় ২৩ জানুয়ারি ২০১১-র ‘পেপার কাটিং’। ফ্রেমে মনমোহন সিংহের সঙ্গে সুনীতা। উপরে লেখা, ‘সাবাস সাহসিনী’। |