তা বলে কি আড্ডা দেব না
নবদলের কলকাতা। এই মনবদল ধরা যায় আজকের কলকাতার খোলা জমায়েতের ধারায়। জমায়েত তো খোলামেলাই হয়। কিন্তু অন্য ধারার কথা বলে এই জমায়েত। বেডরুমের বন্ধ দরজা বা চিলেকোঠার এক কোণের গোপনীয়তা ছেড়ে কখনও কলকাতার সমকামী, কখনও বা চরম নেশা থেকে বেরিয়ে আসা একদল মানুষ। আবার কখনও বা কবিতা-পাগল, বা কোনও গায়ক মানুষ শহরের বিভিন্ন পাব থেকে কফি শপে নিজেদের মেলে ধরছেন। এই শহরের রাজপথই তাদের আরাম-কুঠি। তাঁদের মন ঘেরা আড্ডার উপস্থিতি এখন এতটাই উজ্জ্বল যে কলকাতার কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, পাব থেকে কফিশপ এখন তাঁদের আড্ডা স্টপ হিসেবেই পরিচিত। কেমন সেই মানুষের দল? কী বা তাঁদের পরিচয়?
ব্রাউন সুগার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাওয়া মানুষের সংগঠন ‘নারকোটিক্স অ্যানোনিমাস’। এঁরা বিশ্বাস করেন কাজের পরে মানুষ যখন একা হয়ে যান, তখনই নেশা করতে চান। তাই ওই কাজের পরে একা না হয়ে কলকাতা শাখার ‘নারকোটিক্স অ্যানোনিমাস’-এর সঙ্গে যুক্ত কয়েক জন মানুষ এখন কলকাতার কফি শপগুলোয় নিজেদের মধ্যে আড্ডা জমাচ্ছেন। লেক রোড এবং হিন্দুস্থান পার্কের বারিস্তায় নিয়মিত দেখা যাচ্ছে এমনই একদল মানুষকে। এই আড্ডা ‘নারকোটিক্স অ্যানোনিমাস’-এর কোনও অফিশিয়াল মিট নয়। কফি-পাগল কিছু বন্ধর ‘বারিস্তা’-ই এখন বাড়ি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘নারকোটিক্স অ্যানোনিমাস’-এর এক সদস্য জানালেন, ‘‘আমাদের বন্ধুবান্ধবরা কাজের পর লেক রোডের ‘বারিস্তা’-য় জমা হয় আড্ডা মারতে। কোনও বন্ধুর বাড়িতে আমরা সে ভাবে কমফর্টেবল ফিল করি না বলেই জায়গাটা বেছে নিয়েছি।” ‘বারিস্তা’-র এই বন্ধুদের দলে এমনও মানুষ আছেন, যিনি বারো বছর নেশার হাতছানিকে এড়িয়ে রয়েছেন। কেউ বা ভুল করে ব্রাউন সুগারের টানে ফিরে গিয়ে কফি আড্ডায় যোগ দিয়েছেন। আর নিয়মিত যাতায়াত তাঁকে পুরনো নেশা থেকে দূরে রেখেছে। এই দলের মধ্যে শিক্ষা বা বৃত্তি ভেদে কোনও তফাত নেই। এটাই কলকাতার এই ওপেন স্পেসগুলোর মজা। কলকাতার এই বিভিন্ন আঙিনা গড়ে তুলেছে এক অনিয়মিত, অযাচিত, অসচেতন ক্ষেত্র। এ যেন বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নয়, এ যেন নিজের বাড়ি। কাজের শেষে সেখানেই
ফিরবেন আড্ডাধারীরা। এবং কাজ পালিয়ে হাজির হলেও কেউ কোনও প্রশ্ন করবে না। কেবল একা এবং কয়েকজন বন্ধুর আড্ডা।

শুনতে কি চাও তুমি
কবিতা লিখছেন কিন্তু ঠিক মতো শোনানো হচ্ছে না। গিটার হাতে বাড়ি বসে গান গেয়ে দম ফুরিয়ে আসছে। এত সুরে গলা বলছে, কিন্তু শুনছে কে? ৫৬, যতীন দাস রোডের ‘ক্যাফেলা’-র দরবার খুলে দিয়েছে কলকাতার শিল্পী জমায়েতের নতুন দিগন্ত। ‘ক্যাফেলা’-র সঞ্জয় সোম জানালেন, “গিটার ছাড়াও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে এখানে। যে কেউ চাইলেই বাজাতে পারেন। কারও গান গাইতে ইচ্ছে হলে গানও গেয়ে উঠতে পারেন, আবার কেউ ‘ক্যাফেলা’-র কফিতে চুমুক দিতে দিতে আমাদের সংগ্রহে রাখা বই নিয়ে একলা হয়ে যেতে পারেন।” বাঙালির দেওয়াল লিখনের নস্ট্যালজিয়ায় মিউজিক্যাল ‘ক্যাফেলা’-র দেওয়াল সেজেছে নানান শব্দ ভাণ্ডারে। এ যেন কলকাতার শিল্পী মননের অন্য ভুবন। ‘ক্যাফেলা’-র গানের কথা জেনেই কলেজ পড়ুয়া সুমন গিটার চর্চার লোভে ‘ক্যাফেলা’-য় যাতায়াত জমিয়েছেন। ‘ক্যাফেলা’-র পক্ষ থেকে দ্বৈপায়ন রায় জানালেন তাঁরা মাঝে মাঝেই সেলিব্রিটি গায়কদের নিয়ে ‘ক্যাফেলা’-য় খোলা আড্ডা জমান। বললেন, “এই তো অনুপম রায় এসেছিলেন। ওঁর গিটার অন্যের হাতে ধরিয়ে নিজের গান গাওয়ার খুঁটিনাটি জানিয়ে গিয়েছিলেন অনুপম।”
“লেসবিয়ান, গে, বাই সেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার মানুষের এই শহরে দল বেঁধে পার্টি করার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। কোনও কোনও রেস্তোরাঁ আর পাবে এলজিবিটি কমিউনিটির মানুষকে আলাদা ভেবে তাঁদের কাছ থেকে আজও অতিরিক্ত টাকা চাওয়া হয়।
ঠিক দু’বছর আগে ‘লা ডল সেভিটা’, যা সাধারণত গে-পাব হিসেবেই পরিচিত, সেখানে এলজিবিটি কমিউনিটির প্রবেশ নিয়ে নানান আপত্তি আসে। “তখন রক্সি আমাদের সহযোগিতা করে। রক্সির আন্ডারগ্রাউন্ডেই আমরা প্রথম পার্টি করি প্রায় দু’বছর আগে,” জানালেন ডিজাইনার নভোনীল দাস। বললেন ওই আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি থেকেই ‘পিঙ্ক পার্টি’-র জন্ম হয়। দু’বছরের মধ্যে এই পার্টির সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় দেড় হাজার।
এলজিবিটি-র অন্তর্গত নয় এমন কেউ চাইলেও এই পার্টির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। ঘরের কোনায় না থেকে আরামদায়ক পাবলিক প্লেসে আড্ডা দেওয়ার কথা ভেবেই ‘পিঙ্ক পার্টি’-র জন্ম। কিন্তু ‘পিঙ্ক পার্টি’ কেবল পার্টি করে না। এলজিবিটি কমিউনিটির সদস্যরা যাতে কোনও এনজিও বা সরকারি সংস্থার বাইরে এসে স্বাভাবিক জীবনে পা মেলাতে পারেন সেটাই ‘পিঙ্ক পার্টি’-র মূল উদ্দেশ্য। “কেবল অনলাইন মিট করলেই তো আর বন্ধুত্বের খিদে মেটে না। প্রত্যেকে আমরা যাতে একে অপরের কাছাকাছি আসতে পারি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে ‘মিসেস ম্যাগপাই’-এ ‘পিঙ্ক পার্টি’-র আড্ডা জমাবার ইচ্ছে
আছে। আসলে পিঙ্ক পিকনিক, পিঙ্ক মুভি ক্লাব, পিঙ্ক কফি মিটের মতো নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আমরা একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকি,” নীলের গলায় উচ্ছ্বাস। প্রতি বুধবার রাত ন’টা থেকে ‘মোকা’-য় ‘পিঙ্ক পার্টি’-র পিঙ্ক কফির জমাটি আড্ডা বসে। এ ছাড়াও স্ট্যাডেল, হায়াত-এ ‘পিঙ্ক পার্টি’ নানা উৎসবের আয়োজন করে। কিন্তু ‘মোকা’-তেই রোজের ‘পিঙ্ক পার্টি’-র বুধসন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
মঙ্গল, শনি আর রবিবার ছ’টা থেকে দশটা কলকাতার নন্দন চত্বর, দমদম ফাঁড়ির স্বীকৃতি ক্লাব, নিউ এম্পায়ার বিল্ডিঙের ‘লা দল সেভিটা’-য় নিয়মিত সমকামী পুরুষদের মজলিশি আড্ডা বসে। “শনিবারের সন্ধে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ‘জিঞ্জার’-এ আগে নিয়মিত আড্ডা মারতাম আমি। ইদানীং কাজের চাপে যাওয়াটা কমেছে,” জানালেন কর্পোরেট সেক্টরে চাকুরিরত রাজীব গুহ। সম্প্রতি বন্ধু অভিজিৎ-এর সঙ্গে আংটি বদল করেছেন। আরও জানান, “বাড়ির বাইরে গে মিটটা খুব
প্রয়োজন ছিল। ‘জিঞ্জার’ সেই স্পেসটা আমাদের দিয়েছে।” তবে এখানে কিছু নিয়ম রয়েছে। শনিবারের এই আড্ডায় কেউ একা আসতে পারবেন না। সঙ্গে বন্ধু থাকতে হবে। “অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে কেউ একা এসে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আমাদের পিছনে আমাদের নিয়েই নিন্দে-মন্দ করেছে। এই ধরনের মানুষের থেকে দূরে থাকতে চাই আমরা,” বললেন রাজীব।
জিঞ্জারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কেউ যদিও স্পষ্ট করে বলতে চাইলেন না, কারণ ‘জিঞ্জার’-কে শুধুমাত্র গে-পাব হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবসা খোয়াতে নিমরাজি জিঞ্জারের মালিকপক্ষ।
এ ভাবেই আমাদের শহর আগলে রেখেছে তার নিজের নানা মনের মানুষদের। আর এদের রোজের জমায়েতই বদলে দিয়েছে কলকাতার ক্যানভাস। কোথাও তা সমকামীর মজলিশ, কোথাও পুরনো নেশা ছাড়তে চাওয়া নতুন দলের উচ্ছ্বাস, কোথাও বা গানের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার টান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.