মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার তৃণমূল-পরিচালিত জেলা পরিষদের সভাধিপতির দাবি, উন্নয়নের ১০০ ভাগ কাজ করে ফেলেছেন তিনি। রাস্তা সারানো থেকে১০০ দিনের কাজ, সব ক্ষেত্রেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ ১০০ শতাংশ কাজ করে ফেলেছে, দাবি করলেন শামিমা শেখ।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদেরই তথ্য, রাস্তা সংস্কার ও নির্মাণের ক্ষেত্রে বরাদ্দ টাকার ৬০ শতাংশও খরচ হয়নি। জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে রাস্তার প্রায় ১১০০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা রয়েছে। ওই সব রাস্তায় ইট বিছানোর কাজও করা হয়নি। জেলা পরিষদের একটি সূত্র বলছে, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে রাস্তা মেরামতের আনুমানিক আর্থিক বাজেট তৈরি করতেই অক্টোবর পেরিয়ে গিয়েছে। স্বভাবতই কাজ হয়েছে খুব সামান্য।
শুধু রাস্তা নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অধিকাংশ এলাকা আর্সেনিকপ্রবণ। পাইপের মাধ্যমে পানীয় জল বাড়ি বাড়ি পৌঁছনোর প্রকল্প চালু করা হয়েছে এই জেলায়। এর মূল দায়িত্ব পঞ্চায়েত সমিতির। সমিতির মাধ্যমে তা বিভিন্ন আর্সেনিক প্রবণ এলাকায় পৌঁছনোর দায়িত্ব জেলা পরিষদের। জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় পাইপলাইন থেকে জল চুরি হচ্ছে অবাধে। দক্ষিণ শহরতলির বিষ্ণুপুর ১ ও ২ নম্বর ব্লকের অধিকাংশ ফুলের নার্সারির ব্যবসায়ীরা আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল দিয়ে নিজেদের বাগানে জল দিচ্ছেন। পঞ্চায়েত সমিতির নজরদারি নেই বলেই এমন হচ্ছে, অভিযোগ জেলা পরিষদের। ‘স্বজলধারা’ প্রকল্পেরও প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ বাকি।
১০০ দিনের কাজে মাধ্যমে আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে কাজের ক্ষেত্রে দলতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে, অভিযোগ বিরোধীদের। তাঁদের নালিশ, এখনও অধিকাংশ নদীবাঁধ অরক্ষিত। কোনও রকমে দায়সারা কাজ করা হয়েছে। প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আয়লার পর ২০১০ নভেম্বরে ৫০৩৪ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। গত তিন বছরে দশ শতাংশও খরচ হয়নি। মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে, টাকা এবার ফিরে যাবে। জেলা পরিষদ বাঁধের জন্য কোনও কাজই করেনি।”
জেলায় ২৬ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ, অথচ মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্য ১৬ লক্ষ টাকার এক পয়সাও খরচ হয়নি গত অর্থবর্ষে। মুসলিম ছাত্রীদের হস্টেল তৈরির জন্য প্রায় ছয় কোটি টাকারও সেই একই দশা। এমনকী পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের থেকে ৫০ কোটি টাকারও বেশি খরচ না হয়ে পড়েই রয়েছে। কান্তিবাবুর অভিযোগ, “জেলায় একটাও নতুন মাদ্রাসা তৈরি হয়নি। বাম আমলে ধোলার শঙ্করপুরে একটি পলিটেকনিক কলেজের জন্য ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এত দিনেও কাজ এগোয়নি।”
উন্নয়নের বহু কাজই বন্ধ হয়ে রয়েছে জেলায়, কারণ ঠিকাদার সংস্থাগুলি রাজি হচ্ছে না কাজ করতে। একটি ঠিকাদার সংস্থার মালিক কৌশিক দত্তগুপ্ত বলেন, “এক দিকে টাকা পেতে অনিয়ম। অন্য দিকে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের অত্যাচার। দুই মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, কেউ কাজ করতে রাজি হচ্ছে না।”
মানব উন্নয়নের নিরিখে দক্ষিণ ২৪ পরগণা পশ্চিম বঙ্গের একেবারে নীচের দিকে। সেখানেই উন্নয়নের টাকা খরচ হয় না, রাস্তা-আলো-জলের জন্য নিত্য বিব্রত হন মানুষ। গণতন্ত্র কি তবে শুধু ভোটের বাক্সে? নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কি এমন করেই উন্নয়নের প্রতি দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাবেন? |
|
খরচের খতিয়ান (দক্ষিণ ২৪ পরগনা)২০১২-১৩ সালের হিসেব |
|
কিছু প্রকল্প যাতে বরাদ্দের এক টাকাও গত অর্থবর্ষে খরচ হয়নি |
• সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা (১৬ লক্ষ)
• বন (২ লক্ষ)
• তথ্য ও সংস্কৃতি (৪ লক্ষ)
• বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (৬ লক্ষ)
• বিএমএস- মিড ডে মিল (৫ লক্ষ)
• মুসলিম ছাত্রী আবাস নির্মাণ (৫.৮৪ কোটি)
• রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (৩ লক্ষ)
• ভূমি ও ভূমি সংস্কার (২০ লক্ষ) |
কয়েকটি প্রধান প্রকল্পে যত খরচ হয়েছে |
প্রকল্প |
হাতে মোট টাকা |
পড়ে আছে |
খরচ হয়েছে (%) |
বিধায়কের এলাকা উন্নয়নের তহবিল |
২.০৫ কোটি |
৮৯ লক্ষ |
৫৬.৫৮ |
মৎস্য |
২১ লক্ষ |
২০ লক্ষ |
৮.৭২
|
গ্রামীণ জল সরবরাহ |
১.৮৩ কোটি |
১.২৬ কোটি |
৩১.০৮ |
পানের বরজকে অর্থসাহায্য |
২.১০ কোটি |
৫০ লক্ষ |
৭৬.২৩ |
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ |
২.০৫ কোটি |
২৬ লক্ষ |
৮৭.৪৩ |
স্বজলধারা |
৪০ লক্ষ |
৩৮ লক্ষ |
৭.০৫ |
আমার ঠিকানা |
৬.৫৩ কোটি |
৫.২৯ কোটি |
১৮.৯০ |
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র |
২.৬৫ কোটি |
১.৩৭ কোটি |
৪৮.১২ |
জেলা জনস্বাস্থ্য সেল |
৯৩ লক্ষ |
৭ লক্ষ |
৯২.২৬ |
পশ্চাৎপদ গ্রাম উন্নয়ন |
২০ লক্ষ |
৩ লক্ষ |
৮৭.৪৮ |
পশ্চাৎপদ এলাকা
উন্নয়ন প্রকল্প (বিআরজিএফ)
|
৮১.৯৬ কোটি |
২৫.৫৪ কোটি |
৬৮.৮৩ |
শিশুশিক্ষা কেন্দ্র/ শিশুশিক্ষা |
৪৯ লক্ষ |
৪৫ লক্ষ |
৬.৯২ |
টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন |
৩৩.১৭ কোটি |
৩.২৯ কোটি |
৯০.০৭ |
ইন্দিরা আবাস যোজনা |
৯১.৫২ কোটি |
৮৩ লক্ষ |
৯৯.০৯ |
আশ্রয় |
২.০৫ কোটি |
.৪৯ লক্ষ |
৯৯.৭৬ |
সাংসদের উন্নয়ন তহবিল
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মুকুল রায়
চৌধুরী মোহন জাটুয়া
কবীর সুমন |
|
|
|
৭৫ লক্ষ |
৪৩ লক্ষ |
৪২.৭৮ |
২৫ লক্ষ |
৫ লক্ষ |
৭৯.৯৬ |
৪.৮৮ কোটি |
৮৭ লক্ষ |
৮২.২৬ |
৪ লক্ষ |
০ |
১০০ |
|