পণ দিয়েই বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর যথারীতি আরও পণের দাবিতে শুরু হল অত্যাচার। মেয়েটি তখন প্রথমে পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, পুলিশ হাত গুটিয়ে বসেই থাকল। মেয়েটি এ বার আদালতে এলেন। কলকাতা হাইকোর্ট এখন শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছে, পণের পুরো টাকা এবং বিয়ের সময় পাওয়া মেয়ের যাবতীয় গয়না ও উপহার সামগ্রী অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে।
হাওড়ার শ্যামপুর থানা এলাকার আলপিন গ্রামের বাসিন্দা বাসন্তী মণ্ডল। তাঁর সঙ্গে শ্যামপুরেরই বেলপুর-অযোধ্যা গ্রামের বাসিন্দা অনিমেষ মণ্ডলের বিয়ে হয়েছিল ২০১০ সালে। নগদ ৫০ হাজার টাকা পণ, সঙ্গে গয়না ও অন্যান্য সামগ্রী। কিন্তু বিয়ের ছ’মাস পর থেকেই শ্বশুরবাড়িতে বাসন্তীর উপরে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শুরু হয় বলে আদালতে জানিয়েছেন বাসন্তীর আইনজীবী সৈয়দ মুজিবর রহমান। বাপের বাড়ি থেকে আরও টাকা নিয়ে আসার জন্য নিয়মিত চাপ দেওয়া হতো তাঁর উপর। অত্যাচার এক সময় এতটাই বাড়ে যে, বাসন্তী পালিয়ে শ্যামপুর থানায় বধূ নির্যাতনের (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ) মামলা দায়ের করেন। কিন্তু পুলিশ শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ। বাসন্তী এখন আলাদা ভাবে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি হাইকোর্টে এসেছিলেন পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিচার চেয়ে। |
মঙ্গলবার বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের এজলাসে মামলাটি ওঠে। বিচাপরতি সবার আগে শ্বশুরবাড়িকে নির্দেশ দিয়েছেন, বাসন্তীকে তাঁর পণের টাকা ফেরত দেওয়ার। আগামী মঙ্গলবার মামলাটির পরবর্তী শুনানি হবে। সে দিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আদালত তার বক্তব্য জানাবে। কিন্তু বিচারপতির এখনকার নির্দেশ নিয়েও আইনজীবী মহলে যথেষ্ট চর্চা চলছে। কারণ, পণ দেওয়া-নেওয়া আইনবিরুদ্ধ হলেও পণ নিয়ে এই ধরনের মামলার সংখ্যা কম।
কেন? আইনজীবী মহলের ব্যাখ্যা, বিয়ের সময়ে পণ নেওয়ার অভিযোগ উঠলে বিয়ের আসরে গিয়ে পাত্রপক্ষকে গ্রেফতার করার নজির রয়েছে। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আর পণ দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায় না। এই মামলাটির ক্ষেত্রে বাসন্তীও পণের কথা বলেছেন এবং ঘটনাচক্রে বাসন্তীর শ্বশুরবাড়ির তরফের আইনজীবীও পণ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তাই বিচারপতির সুবিধা হয়েছে। মামলাটিকে সে দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদারও। তাঁর কথায়, ‘‘পণপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও কোনও না কোনও চেহারায় পণের লেনদেন যে চলছেই, সে কথা সকলেরই জানা। অথচ সেটা আইনে প্রমাণ করা যায় না। হাইকোর্টের এই নির্দেশ আইনত প্রমাণ করল, পণপ্রথা টিকে আছে।”
অথচ পণপ্রথা বিরোধী আইন অনুসারে বিয়েতে পণ দেওয়া-নেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে ১৯৬১ সাল থেকেই। মেয়ের বাবা-মা যদি নিজেদের আগ্রহে, স্বেচ্ছায় মেয়েকে স্ত্রীধন বা অন্যান্য উপহার সামগ্রী দিতে চান, নিয়ম অনুযায়ী সেই জিনিসপত্রের তালিকা এসডিও-র কাছে জমা দেওয়ার কথা। এবং ওই সব জিনিসপত্র যে পণ নয়, সেটাও সেখানে নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়ার কথা। আইনে বলা আছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি
মেয়েটির এই উপহারের জিনিসপত্র গায়ের জোরে অধিকার করতে যায়, তা হলে সেটা পণের জন্য বধূনির্যাতন হিসেবেই দেখা হবে। কিন্তু আইনের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক অনেকটাই। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কেউই পণ দেওয়া-নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। পাত্র পক্ষ মানে না, তারা পণ নিয়েছে। বিয়ে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পাত্রী পক্ষও বলে না যে, তারা পণ দিয়েছে।
রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য তথা আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি বললেন, পণ নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ এমনিতে কিছুমাত্র কমেনি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা মুখ খোলেন নির্যাতিতা হওয়ার পরে। পণের লেনদেন যে হয়েছিল সেটা তখনই জানা যায় কেবল, তার আগে নয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র সমীক্ষা বলছে, পণের জন্য বধূহত্যার ঘটনা বরং দিনকে দিন বাড়ছে। ২০১১ সালে গোটা দেশে ৮৬১৮টি এই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, ২০১০-এ সংখ্যাটা ছিল ৮৩৯১। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়েই পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জমি কেনাবেচা হয়।
এ দিন বিচারপতি সরাসরি বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কী চান। ২২ বছরের বাসন্তী স্পষ্ট জানান, নতুন বিয়ে করে সংসার পাততে চান। পণের টাকা ফেরত পেলে তাঁর বিয়ের খরচ জোগাড় করতে সুবিধা হবে। এর পরেই বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বাসন্তীর শ্বশুরবাড়িকে পণের ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাসন্তীর শ্বশুরবাড়ির পক্ষের আইনজীবী এ সময় বলেন, এক সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া ক্ষমতা তাঁর মক্কেলের নেই। বিচারপতি বলেন, প্রথম দফায় ৩০ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে। পরের দফায় বাকি ২০ হাজার টাকা।
ভারতীদেবী এই রায়কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘‘আশা করব, এই ঘটনা একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। মেয়েরা পণপ্রথা নিয়ে আরও বেশি করে মুখ খুলবেন। এই রায়কে নজির হিসেবে রেখে পণের টাকা ফেরত নেওয়ার সাহস দেখাবেন।” |