মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ মান্য করিবার কোনও আইনি দায় রাজ্য সরকারের নাই। অতএব, শিলাদিত্য চৌধুরীকে দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে সুপারিশ কমিশন করিয়াছে, তাহাও সরকার না-ই মানিতে পারে। কিন্তু এই সুপারিশে প্রশাসন তথা তাহার সর্বময়ী কর্ত্রীর প্রতি যে তিরস্কার নিহিত আছে, তাহা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ যাহা ভাবেন, মানবাধিকার কমিশনও দৃশ্যত তাহাই মনে করে মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদী চিনিতে ভুল করিয়াছিলেন। ভুল হওয়াই স্বাভাবিক, মুখ্যমন্ত্রী প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা নহেন। মাওবাদী শনাক্ত করা তাঁহার কাজ নহে। রাজ্যে পুলিশ আছে, গোয়েন্দা বিভাগ আছে মাওবাদী খুঁজিবার কাজটি তাহাদের ওপর ছাড়িলেই হয়। কিন্তু তাঁহার বিশ্বাস, তিনি পোশাক দেখিয়াই মাওবাদী চিনিতে পারেন। তাঁহার শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটি বেলদার জনসভায় থামে নাই টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত কলেজছাত্রী হইতে কামদুনির গৃহবধূ, অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর চোখে মাওবাদী ঠেকিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী আন্তরিক বিশ্বাসের সহিত মাওবাদী শনাক্ত করেন, না কি প্রশ্নকর্তামাত্রেই মাওবাদী বলিয়া তাঁহার ধারণা, সেই তর্ক অসার। কিন্তু তাঁহার এই তকমাটি বিপুল ক্ষতি সাধন করিতেছে। প্রথমত, ‘মাওবাদী’রা সত্যই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর। প্রশ্নটিকে সর্বাধিক গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করা বিধেয়। মুখ্যমন্ত্রীর অবিবেচনাপ্রসূত উক্তি সেই গুরুত্বের হানি করিতেছে। দ্বিতীয়ত, শিলাদিত্য হইতে টুম্পা-মৌসুমী রাজ্যের শীর্ষকর্তা কাহারও গায়ে দুর্বৃত্তের তকমা সাঁটিয়া দিলে তাঁহাকে বিপাকে পড়িতেই হয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেওয়া কেবল অশোভন নয়, অন্যায়। মুখ্যমন্ত্রী যাহা করিতেছেন, তাহার দায় বর্তাইতেছে সরকারের উপর। যে জনসভার মঞ্চ হইতে তিনি শিলাদিত্য চৌধুরীকে ‘চিনিয়া লইয়াছিলেন’, সেই মঞ্চটি দলীয় ছিল না কি প্রশাসনিক, সে প্রশ্ন অবান্তর সেই মঞ্চে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন, তিনি এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁহার কথায় দায় তাঁহার সরকারকে, প্রশাসনকে বহন করিতে হইবে বইকী। মানবাধিকার কমিশন রাজ্যকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলিয়াছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নহে। অর্থনীতির দুনিয়ায় ইহা পরিচিত সমস্যা, পরিভাষায় যাহাকে ‘মরাল হ্যাজার্ড’ বলা হইয়া থাকে। এই জাতীয় ক্ষেত্রে এক জনের দায় অন্য জনকে বহন করিতে হয় মুখ্যমন্ত্রীর কথার দায় যেমন রাজ্য সরকারকে বহিতে হইতেছে। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, যেহেতু দায়টি স্বাভাবিক ভাবেই অন্যের ঘাড়ে চালান হইয়া যায়, ফলে অবিবেচক হইবার প্রবণতাও তীব্র হয়। এই তত্ত্বের আলোকে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানটি এক বার দেখিয়া লওয়া ভাল তাঁহার মাওবাদী সন্ধানের অদম্য তাড়নায় শিলাদিত্য চৌধুরীরা ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছেন; আর ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিপূরণ দিতে হইলে (যাহা তিরস্কারের, অর্থাৎ শাস্তির শামিল) সেই দায় বর্তাইতেছে সরকারের উপর। অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনিলে বোধ হওয়া স্বাভাবিক, তিনিই সরকার। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য বা তাঁহার দলের নেতাদের বিশ্বাসও তদ্রূপ বলিয়াই বোধ হয়। সেই নিরিখে তিনি দাবি করিতে পারেন, সরকারের ভুলে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতেছে। তবে, বৃহত্তর গণতন্ত্র তাঁহার এই দাবিটি মানিবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের অন্য নেতাদের নিকট অবিশ্বাস্য বোধ হইতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁহাদের দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীকে সংযত করা। তাঁহার মাওবাদী-অনুসন্ধান কেবল তাঁহাকেই নহে, পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে কালিমালিপ্ত করিতেছে। |