মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর ও গঞ্জের নিশি-নিলয়ে নর্তকীদের উপর রাজ্য সরকার যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়াছিল, সুপ্রিম কোর্ট তাহা রদ করিয়া দিয়াছে। রাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল, নর্তকীদের জন্যই এই সব নিশিনিলয় ক্রমশ সমাজবিরোধী ক্রিয়াকলাপের আড্ডা হইয়া উঠিতেছে, দেহব্যবসা ও নারী-পাচার উৎসাহিত হইতেছে এবং সামগ্রিক ভাবে সমাজের নৈতিকতার অধঃপতন ঘটাইতেছে। এই একটি প্রশ্নে শাসক দল এন সি পি ও কংগ্রেস, বিরোধী দল শিব সেনা এবং বিজেপিসকলের মধ্যেই ঐকমত্য অর্জিত হইয়াছিল। শীর্ষ আদালত অবশ্য সমাজের নৈতিকতা রক্ষার সেই গুরুদায় হইতে রাজনীতিকদের মুক্তি দিয়াছে। সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ অপেক্ষা অনেক গুরুতর কাজ যে সরকারের আছে (যেমন জনসাধারণকে সুশাসন দেওয়া), আদালত তাহাও স্মরণ করাইয়া দিয়াছে।
মহারাষ্ট্র সরকারের নৈতিক অভিভাবকগিরি সম্পর্কে মন্তব্য করিতে গিয়া শীর্ষ আদালত বলিয়াছে উচ্চবর্গীয়, তারকাচিহ্নিত হোটেলগুলিতে ধনীদের মনোরঞ্জনের জন্য যে-ধরনের নৃত্যগীতের ব্যবস্থা আছে, তাহাতে যদি দর্শকদের নৈতিক স্খলন না-হয়, তবে নিম্নবর্গীয় জনতার সস্তার হোটেলে-বারে নর্তকীদের নৃত্যেই বা তাহা হইবে কেন? তবে কি সরকার মনে করে, উচ্চবিত্ত উচ্চবর্গের ক্ষেত্রে যাহা বিশুদ্ধ মনোরঞ্জন, নিম্নবর্গীয় নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রে তাহাই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক উত্তেজনার খোরাক হইয়া অবক্ষয় ও ব্যভিচারকে উস্কানি দেয়? সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্যের নিহিতার্থ অনুধাবন করা কঠিন নয়। মহারাষ্ট্রের সরকার ও বিরোধী পক্ষের রাজনীতিকরা যুগপৎ তাহা করিয়াছেনও। তবে আদালতের বক্তব্য তাঁহাদের স্পষ্টতই পছন্দ হয় নাই। নর্তকীদের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখিতে তাই তাঁহারা শীর্ষ আদালতের বৃহত্তর বেঞ্চে আবেদনে আগ্রহী, তাহাতেও কাজ না হইলে এই বিষয় সংক্রান্ত আইনটি কঠোরতর করা হইবে। সংশোধিত সেই আইন যদি নিশি-নিলয়ে গিয়া নাচ দেখিবার ও দেখাইবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করে, তবে তাহাও যে বিচারবিভাগের নিরীক্ষায় টিকিতে না পারে, ইহা লইয়া তাঁহারা আপাতত ভাবিত নন। মহারাষ্ট্রের নিম্নবর্গীয় মানুষদের নৈতিক চরিত্র তাঁহারা কিছুতেই স্খলিত হইতে দিবেন না! অথচ বাস্তব ঘটনা হইল, ২০০৫ সালে বার-নর্তকীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পর যে ৭৫ হাজার পেশাদার নর্তকী কর্মহীন হইয়া পড়েন, তাঁহাদের অনেককেই রুজি-রুটির দায়ে শেষ পর্যন্ত সেই দেহ-ব্যবসায়েই নামিতে হয়। কেহ কেহ আত্মঘাতীও হন। যে আড়াই হাজার নিশিনিলয়ে ঝাঁপ পড়িয়া যায়, তাহার কর্মীরাও বিপন্ন হন, অনেকে কার্যত অপরাধ-জগতের নিরুপায় আকর্ষণেই লীন হইতে থাকেন। জনসাধারণের রুচি, নীতি, নৈতিকতা ঠিক করিতে কৃতসঙ্কল্প রাজনীতিকরা এই ‘অধঃপাত’-এর কারিগর। উপরন্তু শরদ পওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস এবং প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের শিব সেনা যখন মরাঠি সমাজের নৈতিকতার প্রশ্নে অভিন্ন বিন্দুতে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন বুঝিতে হইবে রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্তত এই অবস্থান মঞ্জুর করে। আর বিপদটাও সেখানেই। মরাঠি সমাজে এক সময় অনেক প্রগতিবাদী সংস্কার-আন্দোলন হইলেও ইদানীং তাহাকে একটি বদ্ধ জলায় পরিণত করিবার অপচেষ্টা চলিয়াছে, মুম্বইয়ের মতো যথার্থ এক মহানগরের মনোজগৎটিকে একটি অন্ধকূপে পরিণত করিবার এই উদ্যোগ কেবল আপত্তিকর নয়, বিপজ্জনক। নৈতিকতার দোহাই দিয়া মানুষের রুজি-রুটির স্বাধীনতা এবং পছন্দের সংস্কৃতির অধিকার কাড়িয়া লওয়ার চেষ্টা গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের পরিপন্থী। সমাজের ভিতর হইতে এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রতিবাদ সংহত না হওয়ায় আবারও বিচারবিভাগকে হস্তক্ষেপ করিতে হইতেছে। ইহা দুর্ভাগ্যজনক। |