উনি বললেন, ‘‘ওই চাকরি করবে, না কি আরও ইতিহাস পড়বে?’’ আমি আর দু’বার ভাবিনি।
এক বাক্যেই বললাম, ‘‘স্যর, আপনার কাছে আরও পড়ব।’’ |
চলে গেলেন ঐতিহাসিক ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান-নির্মাতা ও পরিচালক বরুণ দে (১৯৩০-২০১৩)। সারাটা জীবন অজস্র মানুষের উপকার করেছেন, সময়ে সময়ে বাঙালিরা উপকারকের সঙ্গে যে ব্যবহার সচরাচর করে বলে রটনা আছে, সেই ব্যবহারে ব্যথিত হয়েছেন, কিন্তু কয়েক প্রজন্মের ছাত্র ও সহকর্মীর অ্যাকাডেমিক জীবনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন নিজের হাতে। কারও কারও জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। এই শেষোক্তদের মধ্যে আমি পড়ি। বরুণ দে নইলে আমার ঐতিহাসিক হওয়া হত না।
আমার সঙ্গে পরিচয় ১৯৭০ সালে। ১৯৬৯-এ পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে বি এসসি পাশ করার পর তখন বি.টি রোডের (এখন জোকা-র) ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে ষষ্ঠ ব্যাচের ছাত্র হয়ে ঢুকেছি। তার আগে প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র আন্দোলনে, বিশেষত ১৯৬৬-র স্ট্রাইকে, খুব জড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বন্ধুরা নকশাল হয়ে গেলেও ওই পথ বেছে নেওয়া আমার সাহসে কুলোয়নি। মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ কেমন হাতছানি দিয়ে ডাকত; পুলিশের নিষ্ঠুরতাকে ভয় পেতাম। সে কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করায় কলেজের বামপন্থী বন্ধুরা আমায় প্রায় রাতারাতি পরিত্যাগ করল। লেখাপড়ায় মন বসত না। আইআইএম-এর পরীক্ষা দিয়ে যখন ভরতি হবার সুযোগ পেলাম, তখন মনের মধ্যে একরাশ অন্ধকার। ভাবলাম, বিপ্লব তো হল না আমার দ্বারা, আমি নিশ্চয়ই ইতিহাসের আবর্জনা আঁস্তাকুড়ের মানুষ, বরং বড়লোক হয়ে পয়সা আর জাগতিক সুখ-আহ্লাদটাই খুঁজি!
আইআইএম-এ প্রথম বছর বরুণ দে-কে পাইনি, উনি তখন এক বছরের ছুটিতে শিমলাতে। ইতিহাস পড়াতেন সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ইনিও এক জন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস তখন আমাদের অবশ্যপাঠ্য ছিল। সেই প্রথম স্কুলের ক্লাস এইটের পর ইতিহাস পড়া। সদ্য বিদেশ-ফেরত সব্যসাচী ভট্টাচার্যের কল্যাণে ইতিহাসে বেশ একটু আগ্রহ-ও জন্মাল। এ দিকে সেকেন্ড ইয়ার ছাত্ররা সব বলল, ‘‘বরুণ দে ফিরে এলে ক্লাস কোরো, উনি যা পড়ান না!’’ আমি বলি, ‘‘কী রকম?’’ তারা বলে, ‘‘উঃ, কী দারুণ ইংরিজি বলেন, একটা কথার জন্যও হাতড়াতে হয় না, ফ্যাক্টগুলো জিভের গোড়ায় থাকে, আর অসাধারণ সব গল্প বলেন।’’
কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারে কোনও আবশ্যিক ক্লাস নেই ইতিহাসের। অথচ সেকেন্ড ইয়ারেই আমাদের ব্যবস্থাপনা-শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কথা, কাজেই তখন ইতিহাসের ক্লাস নিলে তো কোনও চাকরির সুরাহা হবে না। কী করি? ইতিমধ্যে বরুণ দে শিমলা থেকে ফিরে এসে কাজে যোগ দিলেন। লম্বা, বাঙালির তুলনায় বিশাল সাইজের মানুষ, একটু যেন এক দিকে বেঁকে হাঁটেন, হাতে অনেক ভারী ভারী সব বই। সব মিলিয়ে ভয়, সম্ভ্রম, কৌতূহল মেশানো একটা অবস্থা আমার। এক দিন সাহস করে দেখা করে ফেললাম। বললাম ওঁকে আমার কথা, প্রেসিডেন্সির স্ট্রাইক-এর কথা, নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে অপারগতার কথা। বলে বললাম, ‘‘স্যর, আপনার ক্লাস করে তো আর চাকরি পাব না, কিন্তু ইতিহাস সম্বন্ধে আগ্রহ হয়েছে, আর আপনার পড়ানোর কথা এত শুনেছি, আমি কি আপনার ক্লাস ঐচ্ছিক ভাবে করতে পারি, সত্যিকারের মন তো দিতে পারব না?’’ উনি সম্মত হলেন। দুটি ক্লাস পড়ালেন, একটিতে যদ্দূর মনে পড়ে ছাত্র শুধু আমি-ই! একটি ক্লাস ছিল ভারতবর্ষে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব নিয়ে, অন্যটি শিল্পবিপ্লব-এর ইতিহাস। ইতিহাসকে কেমন জীবন্ত করে নিয়ে আসতেন বরুণবাবু! ইতিহাসের গল্প বলতেন। শুধু তা-ই নয়, ওঁর একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য ছিল উনি ওই গল্পগুলো দিয়ে পুরনো দিনের ব্যবসার, রাজনীতির, অর্থনীতির জগৎগুলোকে নতুন করে দেখাতে পারতেন। তা ছাড়া, আমার একটা বিশেষ উপকার হয়েছিল ওঁর ক্লাস করে। বীক্ষায় উনি ছিলেন মার্ক্সবাদী। আমাকে মার্ক্সবাদী ইতিহাস সম্বন্ধে বইয়ের কথা বলতেন, ওঁর বন্ধু বা পরিচিত গবেষকদের কাজের কথা বলতেন, আর সবচেয়ে মুগ্ধ হতাম যা দেখে, তা হল মুঘল ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ বা ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারতবর্ষের কী সম্পর্ক, ছবির মতো দাগ টেনে সেটা পরিষ্কার করে দেখানোর কী আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ওঁর।
এর ফল হল এই যে, আমার ম্যানেজমেন্ট-এর পড়াশোনা মাথায় উঠল। আমি লাইব্রেরি যাই আর ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বইয়ের খোঁজ করি! এখানে অবশ্যই স্মর্তব্য এটাও যে, আই আই এম-এর অন্য কয়েক জন শিক্ষকও উৎসাহ দিতেন এ ব্যাপারে: নীতীশ দে, মৃত্যুঞ্জয় আত্রেয়, কামিনী অধিকারী, নির্মল চন্দ্র, রঞ্জিত সাউ, মণীশ ভট্টাচার্য, হিতেশরঞ্জন স্যান্যাল-এর কথাও মনে পড়ে। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় উপকার হল মার্ক্সবাদী ইতিহাস রচনার যে ধারা, বরুণবাবুর কাছে তার সন্ধান পেয়ে। কলেজে থাকতে ‘বিপ্লব-স্পন্দিত’ বুকে খুব লেনিন হওয়ার শখ ছিল। না পেরে মনে মনে মরে ছিলাম। তার পর মার্ক্সবাদী ইতিহাসতত্ত্ব পড়ে যখন দেখলাম ইতিহাসের চালিকাশক্তি ব্যক্তি নন, শ্রেণি, এবং তার ওপর যখন বুঝলাম তখন এই রকমই বুঝতাম আমরা যে, আমার ব্যর্থতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, শ্রেণিগতও বটে, মনের একটা কী রকম ভার নেমে গেল। এত দিনে যেন আমার ব্যর্থতার একটা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেল! বন্ধু হারানোর ব্যথা মার্ক্সবাদী ইতিহাসতত্ত্বের প্রলেপের মধ্যে যেন একটা সান্ত্বনা খুঁজে পেল।
এই সব ভাবতে ভাবতে আই আই এম-এর দু’বছর শেষ হয়ে এসেছে। শেষ হতে অন্যান্য আই আই এম-এর ছাত্রদের মতো আমিও একটি ভাল মাইনের চাকরি পেলাম, একটি স্কটিশ কোম্পানিতে। পেয়েছি, কিন্তু ব্যবসার জগতে ঢুকতে মনে পুরোটা সাড়া নেই। বরুণবাবুর ক্লাস করে তখন মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীটাকেই বোঝার যেন একটি চাবিকাঠি পেয়ে গিয়েছি। তখন আমি একটি কোম্পানির সেই একটি সীমিত জগতে ঢুকি কী করে? আই আই এম-এ সে বছরই সদ্য ডক্টরাল প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। বরুণবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উনি বললেন, ‘‘ওই চাকরি করবে, না কি আরও ইতিহাস পড়বে?’’ আমি আর দু’বার ভাবিনি। তখন জানি যে, ইতিহাস না পড়লে (আমার) জীবন বৃথা। এক বাক্যেই বললাম, ‘‘স্যর, আপনার কাছে আরও পড়ব’’।
আই আই এম-এর ফেলো প্রোগ্রামে ভর্তি হলাম, ছোট্ট একটি বৃত্তি নিয়ে। কিন্তু সে বছর একটা গোটা বছর ধরে বরুণবাবুর সঙ্গে একা একা ক্লাস করলাম। ভারতীয় ইতিহাসের ক্লাস। তিন মাস পড়িয়ে পরীক্ষা নিতেন। এক বছরের শেষে এক দিন একটি থান ইট ইংরেজি বই দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই দেখো, টমসন সাহেব কেমন ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস লিখেছেন। আমাদের এ রকম বই নেই। তুমি লিখবে?’’
কোনও দিন পারিনি বরুণবাবুর স্বপ্নের সেই বই লিখতে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, বরুণবাবুর ওই প্ররোচনা, উৎসাহ ও স্নেহ না থাকলে আমার প্রথম বইটি লেখা হত না। আর সেই যে একদা বিজ্ঞানের ছাত্র এক বার ইতিহাসের পথে পা বাড়ালুম, তার পর যা কিছু হয়েছে জীবনে, তার গোড়ায় তো আছেন আমার সেই স্নেহপ্রবণ ও উদারমনা শিক্ষক বরুণবাবু-ই।
|
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক |