সিঙ্গুরের জমি কৃষকদের ফেরাতে চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আইন এখনও আদালতে বিচারাধীন। এরই মধ্যে রাজারহাটে রাস্তার জন্য দানসূত্রে পাওয়া জমি রাজ্য সরকার ফিরিয়ে দিয়েছে দাতা সংস্থাদের হাতেই!
রাজারহাট-নিউটাউনে আবাসন এবং নানা প্রকল্পের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে বহু পরিমাণ জমি বাম আমলেই চলে গিয়েছে সরকারি ও বেসরকারি হাতে। রাজারহাটের কালিকাপুর মৌজায় এমনই প্রায় ৮ একর জমি তিনটি বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা ‘গিফ্ট ডিড’ করে তুলে দিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের হাতে। প্রকল্প এলাকায় যাতে জনস্বার্থে রাস্তা তৈরি করা যায়, তার জন্যই বাম জমানার একেবারে শেষ দিকে ওই জমি সরকারকে দান করেছিল তারা। দু’বছরে রাস্তার জন্য ওই এলাকার পঞ্চায়েত, স্থানীয় বাসিন্দা এবং
স্থানীয় বিধায়ক বর্তমান রাজ্য সরকারকে নানা চিঠি পাঠিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত রাস্তা ওখানে তৈরি হচ্ছে না বলে জানিয়ে রাজ্য সরকার
ফের ‘গিফ্ট ডিড’ করে ওই সংস্থাগুলিকেই প্রায় ৮ একর জমি পাল্টা দান করে দিয়েছে! সংস্থাগুলিকে সরকারি ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘নিজস্ব ব্যবহারে’ তারা ওই জমি কাজে লাগাতে পারে।
রাজ্য সরকারের এমন সিদ্ধান্তে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল এখানে বেআইনি কাজ বা সরাসরি দুর্নীতি নিয়ে নয়। প্রশ্ন নীতির। প্রশাসনিক মহলের একাংশের বিস্ময়, জমির প্রশ্নে রাজ্য সরকার নিজেদের হাত-পা এমনিতেই বেঁধে ফেলেছে। জমির অভাবে প্রায় কোনও প্রকল্পই হচ্ছে না। রাজারহাটেই জমি-জটে ইনফোসিসের মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে রাস্তার মতো জরুরি পরিকাঠামোর জমি হাতে পেয়েও সরকার তা ফিরিয়ে দিতে গেল কেন? তা-ও আবার হাতে-থাকা জমি নিলাম না ডেকে পাল্টা দানই বা করা হল কেন? রাজ্যের ল্যান্ড ট্রাইব্যুনালের এক অভিজ্ঞ আইনজীবীর মতে, “সরকার তার পরিকল্পনা বদল করলে জমি ফিরিয়ে দিতেও পারে। তাকে বেআইনি বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে নথিপত্রে কী হয়েছে, দেখতে হবে। তবে নীতির প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন।” ফিরে পাওয়ার পরে যে জমি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে, তার জন্য স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড় দেওয়া উচিত কি না, উঠেছে সে প্রশ্নও।
জমি এ ভাবে ফেরাতে হল কেন? পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে ব্যস্ত আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য, “ঠিক কী হয়েছে, খোঁজ না নিয়ে বলতে পারব না।” পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার আগেই অবশ্য এই ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল এবং ‘ডিড’ তৈরি করেছিল আবাসন দফতরই। বাম জমানায় ২০১১-র জানুয়ারি মাসে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি জমি দানের চুক্তি করেছিল আবাসন পর্ষদের সঙ্গে।
গত বছর ওই রাস্তা তৈরিতে তৎপর হওয়ার আর্জি জানিয়ে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। যে হেতু নিউটাউনের প্রকল্প এলাকা, তাই হিডকো-র কাছেও একই আবেদন এসেছিল রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে। মমতা সরকারে আসার পরে হিডকো গিয়েছে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের আওতায়। কিন্তু সেই দফতরের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও জানাচ্ছেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। মন্ত্রীর কথায়, “এমনিতে আমাদের নীতি, অধিগ্রহণ করে কিছু করব না। এখানে কী হয়েছে, জানি না।” তবে আবাসন দফতরের
একটি সূত্রের বক্তব্য, ওই রাস্তার মূল পরিকল্পনায় কিছু বদল ঘটিয়ে অন্যত্র করা হতে পারে। সে কারণেই মূল রাস্তার জন্য পাওয়া জমি আর হাতে রাখতে চায়নি সরকার। তবে অন্য কোথাও রাস্তা হলে বিকল্প জমির ব্যবস্থা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর অমিল।
রাজারহাট-নিউটাউন সংলগ্ন কালিকাপুর, মহম্মদপুর, চকপাচুড়িয়া, জামালপাড়া ও পাথরকাটা মৌজার বাসিন্দা নিরাপদ সর্দার, সুজিত আলি মির, সীতা নস্কর, রাজেশ গাজী, আব্দুল খালেদ মোল্লারা মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছেই চিঠি পাঠিয়ে ‘বিচার’ চেয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘আমাদের মতো গরিব কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করে নিউটাউন গড়ে তোলা হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য প্রোমোটারদের দেওয়া হয়েছে এটা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে হয়েছে। আপনি কি ওই নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন’?
প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবের মত, “পরিকল্পনা করে নিউটাউনের মতো শহর গড়ে তুললে একাধিক বিকল্প রাস্তা রাখতে হয়। রাজারহাট থেকে মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে বেরোনোর একটা দরকারি রাস্তার পরিকল্পনা বাম আমলে ছিল। রাজারহাটে পরিকল্পনা মতো পরিবহণ নগরী হলেও সেটা কাজে লাগত। এখানে যে জমির কথা বলা হচ্ছে, সেটা যদি ওই রাস্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তা হলে সর্বনাশ হবে!”
কী ছিল আর কী হয়েছে প্রশ্ন অনেক! উত্তর নেই! |