খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল আগেই। তবু সদর স্ট্রিটের কাফের আড্ডায় টেবিল বাজিয়ে নিজেদের ভাষায় গান গাইছিলেন ম্যারিয়েলা, লারা, অ্যানিটা ও এমেলিয়া। বিকেল পাঁচটা বাজতে না-বাজতেই তাঁরা উঠে পড়লেন। মাদার টেরিজার সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী হয়ে মাল্টা থেকে এসেছেন চার কন্যা। এক মাসের মেয়াদের তিন হপ্তা ইতিমধ্যেই পার। অ্যানিটা বললেন, “খুব দরকার না-হলে সন্ধে ছ’টার পরে আমাদের হোটেলের বাইরে দেখতে পাবেন না।”
কলকাতার প্যাচপেচে গরমে কষ্ট হলেও দেশের কায়দায় শর্টস পরার কথাও ভাবতেও পারেন না পেশায় হাসপাতালের নার্স ওই মহিলারা। বড়জোর ক্যাপ্রি, লং স্কার্ট কিংবা ভারতীয় ঢঙে সালোয়ার কামিজে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। লারা প্রায় হেসে গড়িয়ে বলছিলেন, “একটু কাঁধ খোলা থাকলে কিংবা স্কার্টের ঝুল হাঁটুর উপরে উঠলেই যা তাকায় লোকে!”
অতএব, গলদঘর্ম হলেও অনভ্যাসের পোশাকেই ‘এই বেশ ভাল আছি’ মেজাজ! ক্যালিফর্নিয়া থেকে আসা মধ্য তিরিশের লিয়াহ বা ফ্রান্সের তুলুস থেকে হাজির ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী লেয়া দুপ্রাও কলকাতা তথা ভারতের এই অলিখিত ‘পোশাক-বিধি’ মাথায় করে রেখেছেন। লেয়া যা বললেন, তা-ও ‘পররুচি পরনা’র তত্ত্বই বলা যায়! তাঁর কথায়, “দেখুন, কোনও জায়গায় গেলে সেখানকার সংস্কৃতি অনুযায়ী সাজগোজের চেষ্টা করতেই হয়!” সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে মাসখানেকের জন্য এ শহরে এসেছি। টানা অনেক দিন এখানে থাকতে হলে এত নিয়মে কিন্তু হাঁফিয়ে উঠতাম।”
কলকাতায় নিরাপদে থাকতে হলে তা হলে কী কী নিয়ম মেনে চলতে হয়? ব্রিস্টলের সিমন, মিলানের কাতে বা স্পেনের বিলবাওয়ের পেপা-রা যা বললেন, তা মোটামুটি এক কথা। দিল্লির চলন্ত বাসে ধর্ষণ-কাণ্ডের সময় থেকেই ভারতে ধর্ষণের বাড়বাড়ন্তের খবরাখবর পড়ে তাঁদের দেশের শুভানুধ্যায়ীরাও ওই মেয়েদের পইপই করে সাবধান করে দিয়েছেন। সুতরাং, ওঁরা চেষ্টা করেন সন্ধের পরে কোথাও গেলে দল বেঁধে ঘুরতে। আর কিছুটা ‘রক্ষণশীল’ পোশাক পরেই ঘুরতে। |
“পুলিশ যদি মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে একটু ভাবত!”
পার্নো মিত্র, অভিনেত্রী |
|
কোনও কাজে বা বেড়াতে কলকাতায় আসা বিদেশিনিদের এই আশঙ্কা কি নেহাতই অমূলক? প্রসঙ্গত, যোধপুর পার্কে গত শনিবার রাতে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের খপ্পরে পড়েছিলেন যে ফরাসি তরুণী, তাঁকেও তো লেক থানার পুলিশের কাছে শুনতে হয়েছে সেই প্রশ্ন ‘আপনি কী পোশাক পরেছিলেন?’ পুলিশের এই প্রশ্ন শুনেই তিতিবিরক্ত অভিনেত্রী পার্নো মিত্র। “এর মানে কী? মেয়েদের পোশাকের বিষয়ে এই কৌতূহলের বদলে পুলিশ যদি মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে একটু ভাবত!” পার্নোর বক্তব্য, “বারাসত-টাতে যা সব ঘটছে, সেখানে তো সাধারণ ভারতীয় পোশাক পরেই ছিলেন মেয়েরা। তা হলে কেন ঘটনাগুলো ঘটল?”
এই বিশ্বায়নের যুগে ভারত তথা বাংলার এক-একটি ধর্ষণের ঘটনার অভিঘাত এখন আর শুধু এ দেশের মধ্যেই আটকে থাকে না। আদতে বরাহনগরের মেয়ে, জার্মানির মাইন্জ শহরের বাসিন্দা সুস্মিতা ধর লুকাস যেমন। বাংলা খবরের কাগজের ইন্টারনেট সংস্করণে তেমন কোনও ঘটনার কথা পড়লেই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। “স্থানীয় কাগজে ওই সব বেরোলেই হয়ে গেল! আমার জার্মান স্বামী-শাশুড়িদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যায়! আর আমি কলকাতায় থাকার সময়ে কিছু ঘটলে ওঁরা সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা করেন।” সুস্মিতার মতে, “রক্ষণশীলতার নামে কলকাতায় এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিন্সের মতো পোশাককেই অশ্লীল বলে দেগে দেওয়া হয়। এটাও মানা যায় না!”
রাতের কলকাতায় ফরাসি তরুণী ও তাঁর সঙ্গী যুবকের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা-ও ঠিক একই ভাবে ভারতের তথা কলকাতার নেতিবাচক ভাবমূর্তিই খাড়া করছে। কলকাতায় অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশি কনস্যুলেটগুলি কূটনৈতিক কারণে ‘অপ্রিয়’ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও এ শহরের অতিথি বিদেশিরা তাঁদের আশঙ্কা গোপন করছেন না। মাল্টার মেয়েরা যেমন বলছেন, নিজের দেশে রাত-বিরেতে বেরোতে অত ভাবতে হয় না। সেখানে পোশাক নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না। ব্রিটেনের সিমনের কথায়, “কলকাতা বা দিল্লিতে তো এক দিন আমাদের বেশি রাতে পার্টি করার ইচ্ছে হতেই পারে! সব-কিছু নিয়ে অত ভাবতে কিন্তু বড্ড বিরক্ত লাগে।”
এত কিছুর পরেও কলকাতা আসা বিদেশিনিরা অনেকেই বারবার ফিরে আসতে চান। এক বছরের বেশি কলকাতাবাসী, লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্রিস্টিন পাইক এখন দিব্যি বাংলায় ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কলকাতার লোকজনের ব্যবহার, মুখরোচক ঝাল রান্না সব কিছুই দারুণ লাগে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী ওই তরুণীর। তিনি বললেন, “অগস্টে আমায় ফিরতে হবে। কিন্তু অবশ্যই আবার আসব।” তবু এক-একটা ঘটনা ক্রিস্টিনকেও ধাক্কা দিয়ে যায়। তাঁর কথায়, “বারবার বিশ্বাস চুরমার হওয়ার এই ঘটনাগুলো না-ঘটলেই বোধহয় ভাল থাকতাম। হয়তো দূর দেশ থেকে এসেছি বলেই এ সব বেশি করে মনে হয়।” |