মাস চারেকের ইন্টার্নশিপ নিয়ে কলকাতার ফরাসি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গালে এসেছিলেন সে দেশের এক তরুণী। কিন্তু শ্লীলতাহানির ঘটনার আতঙ্কে দেশে ফিরে গেলেন তিনি।
ফরাসি দূতাবাস সূত্রের খবর, বছর বাইশের ওই তরুণী ইন্টার্নশিপ নিয়ে এ দেশে এসেছিলেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গালে যোগ দিয়েছিলেন ‘আতাশে’ বা ‘স্তাজিয়ের’ (ইন্টার্ন) পদে। ইচ্ছে ছিল, মাস চারেকের ইন্টার্নশিপ শেষে দেশে ফিরে গিয়ে ‘কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন’ নিয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ শুরু করবেন।
ঘটনার সূত্রপাত গত শনিবার গভীর রাতে। ১৪ জুলাই ‘ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ডে’ রবিবার পড়ে যাওয়ায়, তার আগের দিনই আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গালে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলেছিল। তার পরে কয়েক জন সহকর্মীর সঙ্গে ওই তরুণী গড়িয়াহাটে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে গভীর রাতে এক পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে যোধপুর পার্কে নিজের কোয়ার্টারে ফিরছিলেন। সে সময়েই মোটরবাইক-আরোহী জনা চারেক দুষ্কৃতী ওই তরুণীর উদ্দেশে কুৎসিত মন্তব্য করে। প্রতিবাদ করলে ওই তরুণী ও তাঁর সঙ্গীর উপরে চড়াও হয় তারা। পুরুষটি মার খেলেও তরুণী কোনও মতে পালিয়ে বাঁচেন। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দার সাহায্যে রেহাই পান তাঁরা। পরে লেক থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণী। এই ঘটনায় রবিবার গ্রেফতার হয় কমল নস্কর। সোমবার সে জামিনে ছাড়াও পেয়ে যায়। ওই ঘটনায় মঙ্গলবার নেপাল সর্দার, বুবাই হাজরা ও ছটু হালদারকে গ্রেফতার করা হয়।
লালবাজারের এক কর্তা জানান, তরুণীর সঙ্গীর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে মারধর ও কটূক্তির মামলা রুজু করা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে ওই যুবক ফের নতুন করে অভিযোগ দায়ের করেন। তার পরেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি ও খুনের চেষ্টার মামলাও রুজু করা হয়। এ দিন নেপাল, বুবাই ও ছটুকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাদের ২২ জুলাই পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন। পুলিশের দাবি, ঘটনার আতঙ্ক এবং ভাষাগত সমস্যার জন্য পুলিশের কাছে প্রথম অভিযোগে শ্লীলতাহানি ও খুনের চেষ্টার কথা লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন ওই যুবক। পরে তাঁকে ডেকে ফের কথা বলার পরে বিষয়টি জানা যায়।
এবং ঘটনার এই আতঙ্কই শহরছাড়া করেছে ওই বিদেশিনিকে। তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, এই ঘটনার পর থেকেই মানসিক ভাবে অসম্ভব ভেঙে পড়েছিলেন ওই তরুণী। তাঁর বন্ধু-বান্ধবেরা বলেন, তিনি কারও সঙ্গে কথা না-বলার জন্য তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন। এর পরেই কলকাতায় থাকার ঝুঁকি নিতে পারেননি ওই তরুণী। মঙ্গলবার রাতেই জরুরি ভিত্তিতে বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে ফ্রান্সে ফিরে গিয়েছেন তিনি। তাঁর এক বন্ধু বলেন, “আগামী শনিবার ওই তরুণীর জন্মদিন। উদ্যাপনের সব পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগে এই ঘটনাই সব কিছু উল্টে-পাল্টে দিয়ে গেল।”
ওই তরুণী চলে যাওয়ায় কিছুটা বিপাকে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গালের কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রছাত্রীরাও। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গালের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ইন্টার্নশিপের জন্য নিয়মিত ফ্রান্স থেকে তরুণ-তরুণীরা কলকাতায় আসেন। কেউ থাকেন তিন-চার মাসের জন্য, কেউ আবার ছ’মাসের জন্য। এখানে এসে তাঁরা ফরাসি ভাষা শেখান, সেই সঙ্গে নানা ধরনের কর্মশালা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন সংস্থার পক্ষ থেকে। ওই তরুণীও এই কাজের জন্যই এসেছিলেন। এই মুহূর্তে তিনিই ছিলেন একমাত্র ‘আতাশে’। আলিয়ঁসের এক ছাত্রী তথা একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত পরমা সেনচৌধুরী বললেন, “আমি ওই তরুণীর কাছে সেপ্টেম্বরের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য বিশেষ কোচিং নিচ্ছিলাম। খুব ভাল পড়াতেন উনি। আরও বেশ কয়েকটি ক্লাসও করাতেন।” শুধু তা-ই নয়, ফরাসিতে টিভি ব্রডকাস্টিং, নিউজ রাইটিং বা এ রকম আরও বেশ কিছু নতুন ধরনের কর্মশালারও আয়োজন করেছিলেন ওই তরুণী। এই অবস্থায় তিনি হঠাৎ ফিরে যাওয়ায় খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছে পরমাদের।
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ সূত্রের খবর, কিছু দিন আগে বিশ্ব সঙ্গীত দিবস উপলক্ষে আলিয়ঁসের পক্ষ থেকে খুব বড় এক অনুষ্ঠানের মূল দায়িত্বেও ছিলেন ওই তরুণী। ‘ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ডে’-র অনুষ্ঠানেরও কালচারাল কো-অর্ডিনেটর ছিলেন তিনি। আলিয়ঁস কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, এই মুহূর্তে নতুন কোনও ইন্টার্ন আসার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি। কাজেই ওই তরুণীর জায়গাটি ফাঁকাই রয়েছে।
ঘটনার পর থেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছেন ওই তরুণীর সঙ্গী যুবকও। আলিয়ঁসের উচ্চপদে কর্মরত ওই যুবক বছর দেড়েক কলকাতায় রয়েছেন। তিনি বলছেন, “প্রিয় শহর কলকাতায় এমন ঘটনা আশা করিনি।” তাঁর মতে, এর পরে ফ্রান্স বা অন্য কোনও দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা কাজের জন্য কলকাতায় আসার আগে হয়তো বহু বার ভাববে।
|