|
|
|
|
|
|
|
মূলধনী লাভ কর |
সম্পত্তি বাড়বে, করও বাঁচবে। হলে মন্দ কী?
ফ্ল্যাট বা বাড়ির মতো শেয়ার ও বন্ড কিনেও কর ছাড় পাওয়া যেতে
পারে।
মূলধনী লাভ করের আরও কিছু খুঁটিনাটি নিয়ে আজ
শেষ কিস্তি
লিখছেন নারায়ণ জৈন |
|
ক্যাপিটাল গেইন্স ট্যাক্স (মূলধনী লাভ কর) নিয়ে আগের পর্বের আলোচনায় জেনেছি, নতুন বাড়ি/ফ্ল্যাট কিনে বা তৈরি করে কী ভাবে কর রেহাই মেলে। কিন্তু এমন তো হতেই পারে যে, বাড়ি/ফ্ল্যাট কেনার কোনও ইচ্ছে নেই আপনার। অথচ মূলধনী লাভের টাকায় করও দিতে চান না। সে ক্ষেত্রে কী করবেন? কর মকুবের অন্য রাস্তা আছে কি? আবার এমনও কিছু ক্যাপিটাল অ্যাসেট হস্তান্তর রয়েছে, যেগুলি এই করের আওতাতেই পড়ে না। চলুন, আজ কথা বলি এই সব বিষয় নিয়েই। পাশাপাশি, ৫০ লক্ষ বা তার বেশি টাকায় ফ্ল্যাট-সহ কোনও স্থাবর সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে কর দেওয়ার যে নতুন বিধি তৈরি হয়েছে, চোখ রাখব তাতেও।
তবে এক্কেবারে প্রথমে আপনাদের সুবিধার জন্যই মূলধনী লাভ হিসাবের নিয়মটা আর একবার ঝালিয়ে নিচ্ছি।
মূলধনী লাভের হিসাব
ক্যাপিটাল অ্যাসেট বেচে যত টাকা পাবেন, তার থেকে তিনটি খরচ বাদ দিতে হবে। যেটা পড়ে থাকবে, সেটাই মূলধনী লাভ। তিনটি খরচ হল সম্পদটি কেনার খরচ।
• তা উন্নত বা ব্যবহারযোগ্য করে তোলার খরচ।
•
হস্তান্তর বা বিক্রির আনুষঙ্গিক খরচ।
তবে দীর্ঘকালীন মূলধনী লাভ হিসাবের সময়ে ক্যাপিটাল অ্যাসেট কেনার ও তা ব্যবহারযোগ্য করে তোলার খরচের উপর ‘কস্ট ইনফ্লেশন ইনডেক্স’ বা মূল্যবৃদ্ধির সূচক প্রয়োগ করা হয়। এই সূচকের ভিত্তি-বছর ধরা হয় ১৯৮১-’৮২ অর্থবর্ষ। ওই বছরের জন্য নির্দিষ্ট ১০০ পয়েন্ট। ওই ভিত্তি-বছর ধরেই পরের বছরগুলির সূচক ধার্য হয় মূল্যবৃদ্ধির হার অনুযায়ী।
যেমন, ২০১২-’১৩ অর্থবর্ষের সূচক বেড়ে হয়েছিল ৮৫২ পয়েন্ট। আর চলতি ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষে ৯৩৯ পয়েন্ট। আয়কর দফতর প্রতি বছর প্রকাশ করে এই সূচক (বিষয়টি জানতে গত ২০ জুনের বিষয়-আশয় দেখতে পারেন। তা পাবেন www.anandabazar.com ওয়েবসাইটেও)।
বন্ড ও ডিবেঞ্চার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে অবশ্য মূলবৃদ্ধির সূচক প্রযোজ্য নয়।
|
|
রেহাই বন্ডে
বাড়ি, ফ্ল্যাট, গয়না, শেয়ার যে ক্যাপিটাল অ্যাসেটই বিক্রি করে মূলধনী লাভ ঘরে তুলুন, বাড়ি/ফ্ল্যাট কিনে বা তৈরি করে কী ভাবে তার উপর কর বাঁচাবেন, সেটা বলা হয়েছে আয়কর আইনের ৫৪ ও ৫৪এফ ধারায়। কিন্তু হুট্ বলতে তো বাড়ি কিনে ফেলা যায় না। তার প্রয়োজনও না থাকতে পারে। আর তখনই আপনার চাহিদা পূরণ করবে ৫৪ইসি নম্বর ধারা।
• ৫৪ইসি অনুযায়ী, কোনও ক্যাপিটাল অ্যাসেট বিক্রি করে হওয়া দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের (লং টার্ম ক্যাপিটাল গেইন্স) টাকা দিয়ে ৬ মাসের মধ্যে যদি বন্ড কিনে নেন, তা হলে তার উপর কর দিতে হবে না। যে-দিন আপনি ওই সম্পদটি বিক্রি করলেন, সেই দিন থেকেই ৬ মাস হিসেব হবে।
• মূলধনী লাভের পুরো টাকা লগ্নি করলে, পুরোটাতেই কর ছাড় পাবেন।
• যদি লাভের কিছুটা অংশ দিয়ে বন্ড কেনেন, তা হলে সেই অনুপাতে কর হিসাব করা হবে।
• কেউ যদি প্রয়োজনে তিন বছর মেয়াদ শেষের আগেই বন্ড ভাঙিয়ে, বিক্রি/হস্তান্তরিত করে বা রূপান্তরিত (বন্ড জামিন রেখে ঋণ বা অগ্রিম নেওয়া) করে টাকা ফেরত নেন, তা হলে যে-বছর বন্ড বিক্রি হচ্ছে, সেই বছরের আয় ধরা হবে ওই মূলধনী লাভকে। এবং তাতে কর হিসাব হবে।
• এটা হতে পারে যে, আপনি ২০১৩-র ১০ জানুয়ারি একটি ফ্ল্যাট বেচলেন। মূলধনী লাভ হল এক কোটি টাকা। কিন্তু একটি অর্থবর্ষে ৫০ লক্ষ টাকার বেশি বন্ড কেনা যায় না। এ ক্ষেত্রে আপনি ২০১৩-র ৩১ মার্চের মধ্যে ৫০ লক্ষ এবং ওই ২০১৩-রই ৯ জুলাইয়ের মধ্যে বাকি ৫০ লক্ষ টাকা বন্ডে লগ্নি করতে পারেন। তা হলে এক অর্থবর্ষে ৫০ লক্ষ টাকার বেশি বন্ডে রাখতে হল না, অথচ কর ছাড় পেলেন সেই এক কোটির উপরেই।
শেয়ারও ভাল অস্ত্র
নথিবদ্ধ ইক্যুইটি শেয়ার ও ইক্যুইটি নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট হস্তান্তর করে দীর্ঘকালীন মূলধনী লাভ হলে তার উপর কর দিতে হয় না। অবশ্য এসটিটি (সিকিউরিটি ট্রানজাকশন ট্যাক্স) দেওয়া থাকতে হবে। শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কেনার পর ১২ মাসের বেশি সময় ধরে রাখলেই, তার বিক্রি থেকে হওয়া আয়কে দীর্ঘকালীন মুলধনী লাভ বলে।
স্বল্পমেয়াদে ছাড়
ইক্যুইটি শেয়ার বা ইক্যুইটি নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডে একমাত্র দীর্ঘকালীন মূলধনী লাভের উপরেই পুরো কর রেহাই পাওয়া সম্ভব। তবে ১১১এ ধারায়, এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভের উপর মাত্র ১৫% কর দিতে হয়। শুধু এসটিটি দেওয়া থাকতে হবে।
আওতার বাইরে
এতক্ষণ দেখলাম করছাড় বা রেহাই পাওয়ার শর্ত। এ বার দেখব, কোন কোন ক্যাপিটাল অ্যাসেট হস্তান্তর করের আওতায় মোটে পড়েই না।
(ক) ক্যাপিটাল অ্যাসেট উপহার হিসেবে বা উইল করে হস্তান্তর করলে।
(খ) হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের সম্পদ সম্পূর্ণ বা আংশিক বণ্টন করলে।
(গ) কৃষিজমি বিক্রি করলে।
(ঘ) বন্ড বা ডিবেঞ্চার সংস্থার শেয়ারে রূপান্তরিত করলে।
(ঙ) একক মালিকানার ব্যবসা বা অংশীদারি সংস্থা (পার্টনারশিপ ফার্ম) কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হলে। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত পালন করতে হয়।
উপহারে কর লাগবে
আগেই বলেছি, যিনি উইল করে বা উপহার হিসেবে আপনাকে কোনও ধরনের ক্যাপিটাল অ্যাসেট দিচ্ছেন, তিনি মূলধনী লাভ করের আওতায় পড়েন না। কিন্তু যাঁকে ওই সম্পত্তি দেওয়া হল, তিনি পরবর্তী কালে তা বিক্রি বা হস্তান্তর করলে মূলধনী লাভ কর দিতে হবে। কিন্তু তিনি তো ওই সম্পত্তি টাকা খরচ করে কেনেননি। তা হলে
মূলধনী লাভ হিসেব হবে কী করে?
১) মূলধনী কর হিসাবের প্রথম শর্ত, মূলধনী লাভের মেয়াদ বিচার। অর্থাত্ তা দীর্ঘকালীন না স্বল্পকালীন। কারণ মেয়াদের বিচারে করের তারতম্য হয়। সে ক্ষেত্রে যে ক্যাপিটাল অ্যাসেট উপহার পাচ্ছেন বা উত্তরাধিকার সূত্রে হাতে আসছে, দেখুন পূর্ববর্তী মালিকের হাতে তা কত দিনের জন্য ছিল। ওই সময়টা মিলিয়েই মেয়াদ ধার্য হবে।
যেমন ধরা যাক, ২০১৩-র জানুয়ারিতে আপনি উপহার হিসেবে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন। দাতা ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন ১৯৯৫-এর জানুয়ারিতে। অর্থাত্ ৩৬ মাসের বেশি হয়ে গিয়েছে ফ্ল্যাটের মেয়াদ। সুতরাং দীর্ঘকালীন ক্যাপিটাল অ্যাসেট এটি। ফলে এটি বেচে যে মুনাফা করবেন, তা দীর্ঘকালীন মূলধনী লাভ।
২) মূলধনী লাভ বার করতে হলে, যে দামে ক্যাপিটাল অ্যাসেট বিক্রি করা হচ্ছে, তা থেকে সম্পদটি কেনা, উন্নতিসাধন ও হস্তান্তরের আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিতে হবে। কিন্তু সেটি তো আপনি নিজে কেনেননি। তাই এ ক্ষেত্রে দাতা (যিনি আপনাকে সেটি দিয়েছেন) যত টাকায় ওই সম্পদ সংগ্রহ করেছিলেন সেটিকেই কেনার খরচ ধরা হবে। তার পর ওই সম্পত্তির উন্নতির জন্য তিনি বা আপনি যদি কোনও খরচ করে থাকেন, সেটাও বাদ দেওয়া হবে।
৩) মনে রাখবেন, আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে যদি বিনামূল্যে বা স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যের থেকে কম দামে কোনও সম্পত্তি আপনার হাতে আসে, তবে ৫৬(২) ধারায় সেটি আপনার আয় ধরা হবে। এই সম্পত্তি যদি পরে বেচতে যান, তবে তার ক্রয়মূল্য ধরা হবে সম্পত্তিটির স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যের সমান। এবং তার পর সেটি থেকে হাতে আসা মুনাফার উপর মূলধনী লাভ কর হিসাব হবে।
দাম স্ট্যাম্প ডিউটি মাফিক
স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির আগে একটা কথা মাথায় রাখবেন। বর্তমান আয়কর আইন অনুযায়ী, দলিলে ফ্ল্যাটের দাম যত দেখানো থাকে, তা থেকে যদি স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়ন বেশি হয়, তা হলে ওই মূল্যায়ন ধরেই ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স হিসাব করা হবে।
উদাহরণ: বিষয়টি নিয়ে আগেও বলেছি। আবারও বলছি। ধরা যাক, ৫০ লক্ষ টাকায় একটি বাড়ি বিক্রি করেছেন। কিন্তু ওই বাড়ির স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্য নির্ধারিত হল ৭০ লক্ষ টাকা। এ ক্ষেত্রে আপনার হাতে কতটা মূলধনী লাভ আসছে তা হিসাব করার সময় ওই ৭০ লক্ষকেই বাড়ি বিক্রির দাম ধরা হবে। আর তার উপর মূলধনী লাভ কর হিসাব হবে। যদিও আপনি বাড়িটি আসলে ৫০ লক্ষ টাকাতেই বেচছেন।
পুনর্বিবেচনার আর্জি: তবে স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়ন নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট না হলে (বেশি মনে হলে) স্ট্যাম্প ডিউটি রেজিস্ট্রার অফিসে উচ্চপদস্থ কর্তার কাছে আবেদন করতে পারেন। আবার সেটা না-করে, আয়কর দফতরের কর নির্ধারণ আধিকারিকের (অ্যাসেসিং অফিসার) কাছেও যেতে পারেন। সেখানে গিয়ে আবেদন করতে পারেন যে, সম্পত্তিটির মূল্যায়ন আয়কর বিভাগের মূল্যায়ন আধিকারিককে দিয়ে করানো হোক। সে ক্ষেত্রে উনি যদি আগের স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্য থেকে কম মূল্য নির্ধারণ করে দেন, তবে মূলধনী লাভ কর তার উপরেই দিতে হবে।
নির্মাতা যখন বিক্রেতা
ধরুন ফ্ল্যাট-সহ কোনও স্থাবর সম্পত্তির নির্মাতা বা প্রোমোটার নিজেই তা বিক্রি করছেন। তখনও দেখা হবে সেটির স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্য বেশি, না দলিলে দেখানো দাম। যেটা বেশি, তার ভিত্তিতে হিসাব হবে ব্যবসায়িক মুনাফা। এই বিধি কার্যকর হয়েছে গত ১ এপ্রিল থেকে।
|
উত্সে কর ১% |
যখন কোনও স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর হবে, তখন মূলধনী লাভ করের হিসাব মাথায় রাখার পাশাপাশি আর একটি বিষয়ও খেয়াল রাখবেন।
• কৃষিজমি ছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি দামের অন্য যে-কোনও স্থাবর সম্পত্তি কিনলে ক্রেতা যখনই বিক্রেতাকে দাম মেটাবেন, তখনই ১৯৪আইএ ধারায় ১% হারে উত্সে কর (ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স বা টিডিএস) কাটা হবে।
• গত ১ জুন থেকেই এই নিয়ম প্রযোজ্য হয়েছে।
• এ ক্ষেত্রে এক লপ্তে মোট দামের উপর টিডিএস কাটাতে হবে না। পরিবর্তে বিক্রেতাকে যত বার ক্রেতা টাকা মেটাবেন (নগদ, চেক, ব্যাঙ্ক ড্রাফট বা অন্য যে পদ্ধতিতেই হোক), তত বারই টিডিএস কাটা হবে ১% করে। অর্থাত্ বিক্রেতার হাতে প্রতি কিস্তিতে আসা টাকার থেকে ওই ১% জমা পড়বে সরকারের ঘরে।
• এ ক্ষেত্রে সম্পত্তি বিক্রেতার প্যান নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক।
• টিডিএস কাটার ক্ষেত্রে চুক্তিপত্রে/দলিলে লেখা বিক্রয়মূল্যকেই সম্পত্তির দাম ধরা হবে। স্ট্যাম্প ডিউটির মূল্যায়নকে নয়।
|
উদাহরণ: ধরা যাক, ৪০ লক্ষ টাকায় একটি ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু রেজিস্ট্রার স্ট্যাম্প ডিউটি মূল্যায়ন ধার্য করেছেন ৬০ লক্ষ টাকা। এটি কিনতে টিডিএস কাটাতে হবে না। কারণ দলিলে দেখানো টাকা ৫০ লক্ষের কম।
মনে রাখুন: যে-মাসে টিডিএস কাটবে, সেই মাস শেষের পর সাত দিনের মধ্যেই টাকাটা সরকারের ঘরে জমা দিতে হবে ক্রেতাকে। সঙ্গে দিতে হবে ২৬কিউবি ফর্ম। ক্রেতা ১৬বি ফর্মে টিডিএস সার্টিফিকেট দেবেন বিক্রেতাকে। |
|
লেখক আইনজীবী ও কর বিশেষজ্ঞ |
|
|
|
|
|