|
|
|
|
|
|
|
জানেন তো, লগ্নির আগেও শপথ করতে হয়?
শুধু হাতিয়ার জোগাড়ই যথেষ্ট নয়। সঞ্চয়ের দৌড় শুরুর আগে ছকে
নেওয়া প্রয়োজন যুদ্ধ জয়ের কৌশলও। সঙ্গে দরকার একলব্যের সাধনা।
অক্ষরে
অক্ষরে লগ্নির শপথ মেনে চলার । লিখছেন অমিতাভ গুহ সরকার |
|
ব্যাট-বল, গ্লাভস, উইকেট ইত্যাদি থাকলেই ক্রিকেট খেলা শেখা হয়ে গেল, তা কিন্তু নয়। শিখতে হবে হুক, পুল, গ্লান্স ইত্যাদি করে রান তোলার পথ। আক্রমণের জন্য জানতে হয় বিভিন্ন ধরনের বোলিং। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। শুধু হাতিয়ার জোগাড় হয়ে গেলেই লগ্নিতে সাফল্য আসবে না। এর জন্য চাই কিছু জ্ঞান, পরিকল্পনা, অভিজ্ঞতা ও কৌশলের প্রয়োগ। আজ এই দিকগুলিই আমরা একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নেব।
লগ্নির জগতে প্রবেশের সময়ে বা পরে কিছু শপথ নিলে এবং তা মেনে চললে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল মেলে। এগুলি হল
• সঞ্চয়ের টাকা বিনিয়োগ করব, ফাটকা খেলব না।
• শুধুমাত্র অন্যের কথা বা গুজব শুনে কোনও প্রকল্পে লগ্নি করব না।
• কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু হোমওয়ার্ক করব। বুঝে নেব প্রকল্পের ভাল-মন্দ।
• কোনও ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেব। সাইট থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করব।
• রাতারাতি বড়লোক হওয়ার হাতছানি আছে এমন পথে লগ্নি করব না। বরং স্বাভাবিক আয়ের কথা মাথায় রেখে এগোবো। অস্বাভাবিক প্রতিশ্রুতি (যেমন ৩ বছরে দ্বিগুণ ফেরত ইত্যাদি) এড়িয়ে চলব।
• অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেব।
• বিপদে দিশেহারা না হয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবব, কী করে বেরিয়ে আসা যায়। অনেক সময়ে কিছুটা লোকসান মেনে নিয়ে বেরিয়ে আসাটা কিন্তু লাভজনক হতে পারে।
• লগ্নি করে বসে থাকব না। নিয়মিত নজর রাখব তাতে। অবস্থা অনুযায়ী প্রকল্পের রদবদল করব।
• লগ্নি করব খোলা মনে। খাপ খাইয়ে নেব বাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে।
• লগ্নি সংক্রান্ত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার রপ্ত করার চেষ্টা করব।
• শুধুমাত্র ব্রোকার এবং এজেন্টের কথায় সিদ্ধান্ত নেব না। এজেন্টের ‘টাগের্ট’ মেটানোর দায় আমার নয়।
• যে-প্রকল্প জটিল, বুঝতে পারব না, তা এড়িয়ে চলব।
• শেয়ার বাজারে লগ্নির ব্যাপারে সেবি প্রকাশিত করণীয় এবং করণীয় নয় (ডু’স অ্যান্ড ডোন্টস) নির্দেশিকা মেনে চলব।
• অতি চড়া বাজারে শেয়ার কিনব না, পড়া বাজারে বিক্রি করব না।
• সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতির দিকে নজর রাখব। নজর রাখব আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকেও।
• লগ্নি সংক্রান্ত জ্ঞান বাড়ানোর চেষ্টা করব। যাতে অন্যের মুখে ঝাল খেতে না হয়।
লগ্নির বাজারে সফল হতে হলে আরও কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এগুলি নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। |
|
ঝুঁকির মাপজোক
কোনও ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে লগ্নি করার আগে নিজের ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য মাপজোক করে দেখে নিতে হবে। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ধরা যাক, আপনার লগ্নিযোগ্য তহবিল ১ লক্ষ টাকা। সুরক্ষিত জায়গায় লগ্নি করে আপনি বর্তমান বাজারে কমবেশি ৯ শতাংশ অর্থাত্ বছরে ৯,০০০ টাকা আয় করতে পারেন। একই টাকা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে লগ্নি করে আপনার ঘরে আসতে পারে ১২ শতাংশ আয়, অর্থাত্ বছরে ১২,০০০ টাকা। এখন প্রশ্ন হল, মাত্র ৩,০০০ টাকা অতিরিক্ত আয়ের জন্য আপনার একমাত্র সম্বল ১ লক্ষ টাকা খোয়ানোর ঝুঁকি নেবেন কি না। তহবিল বড় থাকলে অল্প-বিস্তর ঝুঁকির কথা ভাবতে পারেন। ঝুঁকি সব সময়ে নিতে হবে অঙ্ক কষে। নিজের সামর্থ্যের বিচারে। অন্যের কথায় নয়। বয়স ৫০ পেরোলে ঝুঁকির পথ থেকে সরে এসে সুরক্ষিত থাকাই শ্রেয়।
এক ঝাঁপিতে সব ডিম নয়
লগ্নির বাজারে এখন বহু প্রকল্প। কম- বেশি ঝুঁকি আছে অনেক প্রকল্পেই। এই কারণে মোটা তহবিল কখনওই ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রকল্পে লগ্নি করা ঠিক নয়। লগ্নি ছড়িয়ে দিতে হবে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পে। এতে ঝুঁকির দরুন লোকসানের সম্ভাবনা কমে। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিন প্রতি ১০০ টাকায় কত টাকা আপনি সুরক্ষিত প্রকল্পে রাখবেন আর কত টাকার উপর ঝুঁকি নিলে আপনার অসুবিধা হবে না। ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে লগ্নি করে মানসিক অশান্তি বহন করাটাও বাঞ্ছনীয় নয়।
লগ্নি দীর্ঘ মেয়াদে
এমন অনেক লগ্নি আছে, যা পাকতে সময় লাগে। মাঝপথে তুলে নিলেই লোকসান। স্থির আয় প্রকল্পে দীর্ঘ মেয়াদে নিয়মিত লগ্নি করে গেলে তা মেয়াদ শেষে বড় তহবিলে পরিণত হতে পারে। ভাল ফল পেতে হলে শেয়ার বাজারে লগ্নি করতে হবে তিন বছর ধরে রাখার কথা মাথায় রেখে। একই কথা প্রযোজ্য ইক্যুইটি-নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ড এবং ইউলিপ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। কম বয়সে নির্দিষ্ট সুদযুক্ত সুরক্ষিত প্রকল্পে নিয়মিত লগ্নি করলে ক্রমপুঞ্জীত সুদ-সহকারে তা পরে বড় তহবিল গড়ে দেয়। পিপিএফ এই ধরনের লগ্নির আদর্শ জায়গা।
প্রকৃত আয়ের সন্ধান
উঁচু সুদ বা মোটা লাভের হাতছানিতে ভুললে চলবে না। প্রযোজ্য কর বাদ দিয়ে দেখতে হবে, নিট আয় কী দাঁড়াচ্ছে। মনে রাখতে হবে, বাজার থেকে কেনা শেয়ার এবং বন্ডের উপর ডিভিডেন্ড ও সুদ দেওয়া হয় ফেস ভ্যালুর উপর, ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে নয়। যেমন ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর কোনও শেয়ারের বাজার দর যদি ১০০ টাকা হয় এবং সেই কোম্পানি যদি ৫০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেয়, তবে প্রকৃত আয় দাঁড়াচ্ছে ৫ শতাংশ। এই আয়কে বাজারের পরিভাষায় ‘ইল্ড’ বলা হয়। বন্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, মেয়াদ শেষে বন্ডের মূল্য পরিশোধ করা হয় ফেস ভ্যালুর ভিত্তিতে। বাজার দরের ভিত্তিতে নয়। অর্থাত্ আপনি যদি ১০০ টাকার বন্ড ১০৫ টাকায় বাজার থেকে কিনে থাকেন, তবে এক দিকে আপনি সুদ পাবেন ১০০ টাকার উপরে এবং অন্য দিকে মেয়াদ শেষে ফেরত পাবেন ১০০ টাকা, ১০৫ টাকা নয়। অর্থাত্ এই ধরনের লগ্নি করার আগে প্রকৃত আয়ের অঙ্ক কষে তবেই সিদ্ধান্ত নিন। |
লেখক ম্যাকলিওড রাসেল ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সেক্রেটারি
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|