তিনি আলতাফ মাহমুদ, ১৯৬৯-এ সুর দিয়েছিলেন জাহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমায়। সে সিনেমার জনপ্রিয় একটি গান আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের থিম সং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’। একাত্তরের ৩০ অগস্ট আরও পাঁচ জনের সঙ্গে একুশের গানের সুরকার বছর ৩৯-এর মাহমুদকেও তুলে নিয়ে যায় পাক সেনারা। তার পরে কারও খোঁজ মেলেনি কখনও।
আরও চারটি গণহত্যার সঙ্গে আলতাফ-রুমি-বদিদের গুম-খুনের ঘটনাও আজ বিচার পেল ঢাকার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে। খালেদা জিয়ার আগের সরকারের সমাজ-কল্যাণ মন্ত্রী, বর্তমানে জামাতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মহম্মদ মুজাহিদকে এই পাঁচ গণহত্যার প্রধান চক্রান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত করে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত।
সাক্ষীরা আদালতে জানিয়েছেন, ঢাকার পাক সেনা-ছাউনিতে মাহমুদদের দেখে ‘আল বদর’-প্রধান মুজাহিদ ক্যাপ্টেনকে ডাকেন। বলেন, “এরা নামী লোক। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দিতে পারেন। তার আগেই সব ক’টাকে নিকেশ করে দাও।”
মুজাহিদ পরামর্শ দেওয়ার পর আলতাফদের বেঁধে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার অনেক পরে দলা পাকানো ছিন্ন-ভিন্ন কিছু দেহাংশ উদ্ধার হয়েছিল পাক সেনাদের ছেড়ে দেওয়া ছাউনি থেকে। ধারণা করা হয়, ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়ে খুন করা আলতাফ, রুমি, বদিদেরই দেহ এগুলি। ইসলামি ছাত্র সঙ্ঘের তৎকালীন প্রধান মুজাহিদ পাক-সহযোগী কুখ্যাত ঘাতক বাহিনী ‘আল বদর’-এরও কম্যান্ডার ছিলেন। ঢাকায় অধ্যাপক ও বিশিষ্ট জনদের হত্যার প্রধান পরিকল্পকও। এই হত্যাকাণ্ডের জন্যও আদালত আজ তাঁকে অভিযুক্ত করে শাস্তি দিয়েছে।
আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন বিচার পেয়ে স্বভাবতই অভিভূত। বলেন, “একটাই কাজ বাকি রইল। কোথায় নিয়ে গিয়ে কী ভাবে বাবাদের খুন করা হল, তা খুঁজে বার করা।” |
আদালতের পথে আলি আহসান মহম্মদ মুজাহিদ। ছবি: রয়টার্স |
রুমির মা জাহানারা ইমাম ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। কিন্তু তার আগে বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিকে। শাহবাগের নতুন প্রজন্মের আন্দোলনকারীরাও পথপ্রদর্শক ‘শহিদ-জননী’-র বিশাল ছবি টাঙিয়ে নিয়েছিলেন চত্বরের মাথায়।
মুজাহিদের ফাঁসির রায় শুনে আজ ফরিদপুর-যশোর-চট্টগ্রামে আনন্দ-মিছিল বেরিয়েছে। ঢাকা ও ফরিদপুরে অনেক গ্রামের মহিলারা শাঁখ বাজিয়েছেন, উলু দিয়েছেন। তখনকার হিন্দু-প্রধান বহু গ্রামকে মুজাহিদের বাহিনী শ্মশান বানিয়েছে। ভিটে ছেড়ে না যাওয়া পরিবারের পুরুষদের হত্যা করা হয়েছে, মেয়েদের বয়স-নির্বিশেষে গণধর্ষণ। এমনই একটি গ্রাম বকচরে একাত্তরের ১৩ মে-র দুষ্কর্মের জন্যও ফাঁসির আদেশ হয়েছে মুজাহিদের। গ্রামের পুরুষদের সে দিন পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছিল।
মাত্র ৩৬ ঘণ্টা আগে গোলাম আযমের কারাদণ্ড অনেককে হতাশ করলেও মুজাহিদের ফাঁসির রায়ে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে শাসক জোট, সকলেই খুশি। প্রজন্ম চত্বরের মুখপাত্র ইমরান সরকার এই রায়কে স্বাগত জানালেও গোলাম আযমের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য সরকারকে আর্জি জানিয়েছেন। জামাত জানিয়েছে, তারা এই বিচার মানে না, রায়ও। তাই কাল তারা হরতাল ডেকেছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করছেন মুজাহিদের ছেলে। কিন্তু এ বারেও শরিক দল জামাতে ইসলামির শীর্ষ নেতার ফাঁসির রায় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন বিএনপি নেতারা। এই বিচার প্রক্রিয়ার সাফল্যে দিল্লি খুশি। সাউথ ব্লক বলছে, অন্য দেশে হওয়া এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ভারতের কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু চার দশকের পুরনো একটি বিষয়ের ফয়সালা হচ্ছে, এটাও কম নয়। বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, শাহবাগ আন্দোলন দেখিয়ে দেয়, একাত্তরে পাক-অনুচর বাহিনীর দুষ্কর্মের বিচার ও শাস্তি চান বাংলাদেশের মানুষের একটা বিরাট অংশ। এই শাস্তি মানুষের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।
|