কেউ বলছেন কলঙ্ক-টিকা মুছল বাঙালির কপাল থেকে, অনেকে আবার রুষ্ট চরম শাস্তি না হওয়ায়। সবাই জানে একাত্তরের গণহত্যার নায়ক তিনিই, বাকিরা এই কাজের সহযোগী মাত্র। কিন্তু ৪২টা বছর তাঁকে কাঠগড়ায় তোলার সাহস দেখায়নি কোনও সরকার। তাঁর ফাঁসির দাবি জানিয়ে জানিয়ে ক্লান্ত বাংলাদেশের মানুষ যেন ভাবতে শুরু করেছিলেন, প্রচণ্ড প্রভাবশালী এই লোকটিকে শাস্তি দেওয়াই অসম্ভব। রাজাকার-শিরোমণি সেই গোলাম আজমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিল ঢাকার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত।
১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী জামাতে ইসলামির এই সর্বোচ্চ নেতার বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ষড়যন্ত্রের পাঁচটি মামলা দায়ের করেছিল বাংলাদেশ সরকার। সব ক’টিতেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাদের ২৪৩ পাতার রায়ে বলেছে, ফাঁসিই যোগ্য শাস্তি গোলাম আজমের। কিন্তু তাঁর নবতিপর বয়স ও অশক্ত স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এই সুদীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, “আমৃত্যু কারাগারের অন্ধকারেই থাকুক এই জঘন্য অপরাধী।” |
পুলিশের গাড়িতে গুলাম আজম। ছবি: এএফপি। |
স্বাধীনতাকামীদের ‘ভারতের অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দিয়ে নিকেশ করার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন জামাতে ইসলামির তত্কালীন আমির গোলাম আজম। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে হত্যা করার জন্য তিনি পাকিস্তানি সরকারের কাছে অস্ত্র ও অর্থ চেয়ে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন। পাক সেনাদের সহযোগী হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন আল বদর, আল শামস, শান্তি বাহিনী, রাজাকার প্রভৃতি বাহিনী, যারা সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে গণহত্যা ও ধর্ষণ চালিয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশছাড়া করার লক্ষ্যেও বেপরোয়া সন্ত্রাস চালায় এই সব বাহিনী। ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরির পরে গোলাম আজম পাকিস্তানে চলে যান। বাংলাদেশ তাঁর নাগরিকত্ব খারিজ করে দেয়। ইসলামি দেশগুলিতে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করতে থাকেন আজম। ১৯৭৫-এ সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি মুজিবর রহমান খুন হয়ে যাওয়ার পরে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮-এ পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফেরেন গোলাম আজম। রাষ্ট্রপতি জিয়া তাঁকে স্বাগত জানাতে যান। গোলাম আজম বলেন, “একাত্তরে কোনও ভুল করিনি। তেমন পরিস্থিতি এলে আবার তা করব।” বাংলাদেশে জামাতে ইসলামির আমির পদেই ফের তিনি বহাল হোন। ২০০০ সালে স্বাস্থ্যের কারণে তিনি দলের এই সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ছেড়ে সরে দাঁড়ান। ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার আমলে তিনি নাগরিকত্বও ফিরে পান।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তাঁর বিচারের দাবিতে বরাবর সরব হয়েছেন। গণ-আদালত বসিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে বেরিয়ে বেশ কয়েক বার তিনি সাধারণ মানুষের জুতোর বাড়িও খেয়েছেন। কিন্তু তার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করতে চার দশক লেগে গিয়েছে। গত বছর জানুয়ারিতে রাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরে আদালতে হাজির হয়ে আগাম জামিন চাইতে গিয়েছিলেন আজম। কিন্তু বিচারক সে আবেদন খারিজ করে তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। তার পর থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারাকক্ষে ছিলেন সাবেক এই জামাত নেতা। সেখান থেকেই তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। গোলাম আজমের শাস্তির বিরোধিতা করে কাল হরতাল ডেকেছে জামাত। আবার তাঁর ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ ও কয়েকটি বামপন্থী সংগঠনও হরতাল ডেকেছে একই দিনে। আজও হরতালের ডাক ছিল বাংলাদেশে। বিক্ষিপ্ত হিংসায় এক আওয়ামি লিগ নেতা-সহ ৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু কালকের হরতালে সমর্থন জানায়নি প্রধান শাসক দল আওয়ামি লিগ। এ দিনের রায়ে সরকার খুশি বলে জানিয়েছেন, আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, “অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইবুনাল স্বীকার করেছে, তাঁর ফাঁসিই হওয়া উচিত। আমরা তো এটাই চেয়েছিলাম।”
কিন্তু তাঁর ফাঁসি না হওয়ায় হতাশ অধ্যাপক মুনতাসির মানুন। তিনি বলেন, “বয়স না দেখে গণহত্যা হয়েছে। সে কাজে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেলেন, তাঁকে বয়সের কারণে ছাড় দেওয়া অযৌক্তিক।” অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “কে বলেছে, এর পরে অন্য একটি সরকার এসে এই অপরাধীকে জেল থেকে মুক্তি দেবে না? বাংলাদেশে এ জিনিস তো হয়েছে। তাই মানুষ হতাশ।” গণজাগরণ মঞ্চও আজমের ফাঁসির দাবিতে ফের অবস্থান শুরু করার ডাক দিয়েছে।
তবে বিষয়টির ফয়সালা হওয়ায় দিল্লি সন্তুষ্ট। যদিও এটা অন্য দেশের বিষয়। তবু নিরপেক্ষ একটি বিচার প্রক্রিয়া ঢাকায় যে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গোলাম আজম যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন— এতে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক খুশি। |