ভারতের বাহিরে অন্তত তিন জন কীর্তিমান ‘বোস’-এর নাম বহু-আলোচিত। তাহার মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন ‘বোস’ এবং জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী সুভাষ ‘বোস’ ভারতসন্তান হইলেও তৃতীয় ‘বোস’টি কিন্তু কেবল নামেই বাঙালি ও ভারতীয়। জন্ম কিংবা কর্ম, কোনও সূত্রেই তিনি বাংলা বা ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবু আজ তাঁহার মৃতু্য-সংবাদের পর তাঁহার পিতৃপরিচয়-সূত্রটুকু আঁকড়াইয়াই বাঙালি গর্বিত বোধ করিতে পারে, কেননা যে বিপুল খ্যাতি ও কীর্তির ছাপ তিনি বিশ্বময় রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার সূত্রে এই বাঙালি পদবি-টি সিলিকন ভ্যালি হইতে মক্কার কাবা পর্যন্ত এক অতুলনীয় প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছে। প্রসঙ্গত, ওই একই পদবি-সম্পন্ন অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতই সফল হউন, তাঁহাদের পরিচয় কিন্তু কেবল বিশেষজ্ঞ মহলেই সীমাবদ্ধ। বিপরীতে, অমর জি বোস-এর নাম সত্য অর্থে সর্বব্যাপী, সর্বচারী। মার্কিন দুনিয়ার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষকতা করিতে করিতে এই ‘বোস’ স্থির করিয়াছিলেন, কেবল শিক্ষকতাই তাঁহার আরাধ্য নহে, গবেষণা ও ব্যবসায়েও পাশাপাশি আত্মনিবেশ করিবেন। অতঃপর খুব দ্রুত পৃথিবীর শীর্ষ শ্রেষ্ঠ শব্দপ্রযুক্তি আবিষ্কারের সহিত যুক্ত হইয়া যায় তাঁহার নাম, এবং নিজ-নামাঙ্কিত বেসরকারি কোম্পানিটি প্রবাদপ্রতিম হইয়া উঠে। কোনও ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ না থাকিবার এই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত তাঁহাকে এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছাইয়া দেয়, যে মাত্রায় খুব অল্প বাঙালিই এ যাবৎ পৌঁছাইতে চাহিয়াছেন কিংবা পারিয়াছেন। একটি শব্দে যদি সেই মাত্রাটির পরিচয় দিতে হয়, তবে সেই শব্দটি হইবে: সাফল্য।
বৌদ্ধিক ও ব্যবসায়িক কৃতিত্বের দুর্লভ মিলনই এই সাফল্যের মূল কথা। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই অমর জি বোস, লুপ্তপ্রায় কৃতী বাঙালি প্রজাতির অন্যতম দুর্লভ দৃষ্টান্ত হইয়াও আর সকল কৃতী বাঙালির অপেক্ষা পৃথক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জগদীশচন্দ্র বসুর মতো অসাধারণপ্রতিভাসম্পন্ন বা ‘জিনিয়াস’ তিনি নহেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র মতো তীব্র অন্তর্দৃষ্টিময় মেধাবীও নহেন, এমনকী প্রযুক্তি-জগতের আর এক সম্প্রতি-প্রয়াত বিস্ময়-ব্যক্তিত্ব স্টিভ জোবস্-এর সমতুল্য দূরদর্শী বা ‘ভিশনারি’-ও নহেন। কিন্তু তিনি যাহা করিতে পারিয়াছেন— তাহা হইল নিজের ক্ষমতাকে আক্ষরিক অর্থে বিশ্বের সেরা মানে তুলিয়া লইয়া যাওয়া, এবং চূড়ান্ত সাফল্যের পথে কোনও ক্ষুদ্র-তুচ্ছ আপসে বিশ্বাস না রাখা। তাঁহার বিজ্ঞানী সত্তা তাঁহাকে পাঠকক্ষের চৌহদ্দি ছাড়াইয়া বাহির করিয়া আনিয়াছে, আবার একই সঙ্গে তাঁহার ব্যবসায়ী সত্তা তাঁহাকে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের সীমানার বাহিরে টানিয়া লহিয়াছে। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি আকাশ-ছোঁওয়া সফল। বোস কোম্পানির ব্যবসায়িক শ্রেষ্ঠতার ভিত্তি বোস-এর গবেষণালব্ধ সর্বোচ্চ মানের শব্দ-প্রযুক্তি: এ কথার উপর জোর দিয়া তিনি বলিতেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি দাম কমাইয়া আপসের বিরোধী, কারণ তাঁহার গবেষণার মান ব্যবসার দামের সহিত যুক্ত। একই সঙ্গে, অসাধারণ শিক্ষক হিসাবে খ্যাত মানুষটি স্নাতক স্তরেও গবেষণামুখী সমস্যার মডেল ছাড়া পড়াইতে নারাজ ছিলেন, কেননা তাঁহার বিশ্বাস, একমাত্র সমস্যার চ্যালেঞ্জই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়াইতে সক্ষম।
লক্ষণীয়, বৌদ্ধিক ও জাগতিক, সারস্বত সাধনা ও অর্থমনস্ক প্রেরণর এই সার্থক সমন্বয় কিন্তু ঐতিহ্যগত ভাবেই বাঙালি প্রবণতার বিরোধী। যে বাঙালি বাজার বলিতে বুঝে প্রবঞ্চনা, ব্যবসায় বলিতে বুঝে দুর্নীতিপরায়ণতা, সেই বাঙালি বিদ্যাবত্তা বলিতে অর্থ-বিমুখতাই জানে। বিদ্বান বাঙালিরাও সাধারণত সেই মানস-রীতিই মান্য করিয়া চলেন। অথচ বাজার ও ব্যবসায়কে সদর্থে ও উচ্চলক্ষ্যে কাজে লাগাইয়া নিজেকে ও (নাম-সূত্রে) নিজের জাতিকে যে কোন গরিমায় অন্বিত করা যায়, দেখাইয়া গেলেন অমর জি বোস। তাই তাঁহাকে বলা যায় শ্রেষ্ঠ অ-বাঙালিসুলভ বাঙালি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত বাঙালি বলিয়া হয়তো তিনিই চিরকাল চিহ্নিত হইবেন, যদিও জন্ম কিংবা কর্ম কিংবা ভাবনাধারা বাঙালিত্ব তাঁহার কোনও কালে কোথাও ছিল না। |