সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের আবহেই পঞ্চায়েত ভোট হল বর্ধমানে। তিন জনের মৃত্যুর ঘটনা ছাড়াও দিনভর বিক্ষিপ্ত মারপিট, গোলাগুলি ও বোমাবাজির অভিযোগ উঠল জেলা জুড়েই।
সোমবার বর্ধমানে নানা ঘটনায় আহত হন ১০ জন। তাঁদের মধ্যে দু’জন সিপিএমের ও ৮ জন তৃণমূলের। ভাতার, রায়না, গলসি ও মন্তেশ্বরে ঘটনাগুলি ঘটে। পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা জানান, ভাতারে ৯, জামালপুরে ও বর্ধমানে তিনজন করে মোট ১৫ জনকে নানা গোলমালে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও গোলমাল ঠেকাতে জামালপুরে ১৪ ও বর্ধমানে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সিপিএমের জেলা পরিষদের এক প্রার্থী সুপ্রভা কার্ফাও রয়েছেন। ভোটের শেষ লগ্নে অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া চারটি বোমা, চারটি আগ্নয়াস্ত্র দু’টি ধনুক চারটি তির আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। |
ভাতারের বামশোর গ্রামে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে আব্দুল হাকিম নামে এক তৃণমূল সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বোমায় আহত হয়েছেন রেজাউল হক নামে আরও এক জন। তৃণমূলের দাবি, সিপিমের সমর্থকেরা তাঁদের লক্ষ করে বোমা ও গুলি ছুঁড়েছে। আহতদের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আব্দুল হাকিমের স্ত্রী সাহানা বিবি বলেন, “সকালে দশটা নাগাদ সিপিএমের পঞ্চায়েত প্রার্থী সোহিনী খাতুনের নেতৃত্বে প্রায় ২০-২৫জনের একটি দল বুথের দখল নিয়ে নেয়। আমার স্বামী কিছু লোকেদের নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে ওরা গুলি চালায়। প্রচণ্ড বোমাবাজিও হয়।” তবে সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অমল হালদার বলেন, “ওই বুথটি তৃণমূল দখল করে নেয়। আমাদের কর্মীরা প্রতিরোধ করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে।” তাঁর আরও অভিযোগ, “যেখানেই আমাদের কর্মীরা প্রতিরোধে গিয়েছেন, সেখানেই পুলিশ তৃণমূলের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের লোকেদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
গলসির হিট্টেগ্রামেও সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে তৃণমূলের তিনকর্মী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আহতদের একজন মদন লেটের অভিযোগ, “আমার স্ত্রী অলোকা সাটিনন্দী পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রাথী। ওঁকে ভোট দিতে আমরা দল বেধে বুথে যাচ্ছিলাম। আচমকা সিপিএমের কিছু লোক আক্রমন করে।” মন্তেশ্বরের রাইগ্রামেও সিপিএমের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই মহিলা-সহ মোট তিন তৃণমূল কর্মী আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ। রায়নার শ্যামাদাসবাটীতে তাপসী রায় নামে এক সিপিএম সমর্থক মারধরের শিকার হয়েছেন। তিনিও হাসপাতালে ভর্তি। রায়নার শ্রীপুর-হিট্টে গ্রামে প্রবীণ সিপিএম সমর্থক গোলাম আহিয়া হাজারিকে তৃণমূলের লোকেরা মারধর করেছে বলে অভিযোগ। বর্ধমানের বেলকাশ পঞ্চায়েতের বিরুটিকুরি গ্রামে বিক্ষুদ্ধ তৃণমূলের সমর্থকদের সঙ্গে তৃণমূলের সমর্থকদের গোলমাল বাধে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়।
মন্তেশ্বরের পুঁড়শুড়ি পঞ্চায়েতের গিরিগড়নগর গ্রামে নির্দল প্রার্থী আব্দুল আজিম শেখ ও তাঁর ভাই শেখ আরজুল হককে তৃণমূলের লোকজন মারধর করে বলে অভিযোগ। বোমাবাজি হয় সিপিএম অফিসে। যদিও তৃণমূল অভিযোগ মানেনি। ওই ব্লকেরই মামুদপুরে জেলা পরিষদের ১৫ নম্বর আসনে ফরোয়ার্ড ব্লক প্রার্থী গোবিন্দ ঘোষের অভিযোগ, সকাল থেকেই তাঁর এলাকার ৮টি বুথে তৃণমূল বুথ দখল করে। তৃণমূল কর্মীরা ভোটারদের ভয় দেখাতে শুরু করলে অনেক বুথের এজেন্টরা পালিয়ে যায়। মামুদপুর, পুঁড়শুড়ি ও কুসুমগ্রাম পঞ্চায়েতে নানা বুথ দখলের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ফরোয়ার্ড ব্লকের জেলা কমিটির সদস্য উৎপল মিত্রের দাবি, “১৫ নম্বর জেলা পরিষদের আসনে যে আট বুথে তৃণমূল সন্ত্রাস চালিয়েছে, সেগুলিতে ফের ভোটের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।” মামুদপুরে তাদের তিন সমর্থকের উপরে সিপিএম হামলা চালায় বলে অভিযোগ তৃণমূলের। জখমদের ভর্তি করা হয় মন্তেশ্বর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
সিপিএমের কালনা জোনাল সদস্য স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, কালনা ১ এবং ২ ব্লকের বহু জায়গায় ঠিক ভাবে ভোট করতে দেয়নি তৃণমূল। এর মধ্যে কালনা ১ ব্লকের বেগপুর ও সুলতানপুর পঞ্চায়েতে পাঁচটি এবং বাঘনাপাড়ার ২টি আসনে যাতে আবার ভোট নেওয়া হয়, সে জন্য জেলা নেতৃত্বকে জানানো হয়েছে।
কালনা ২ ব্লকের অর্জুনা গ্রামে এক অন্ধ ভোটারকে ঘিরে তৃণমূল এবং সিপিএম কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। অভিযোগ, বাড়ি থেকে গাড়ি করে ওই ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসে তৃণমূল। সিপিএম আবার দাবি করে ওই ব্যক্তি তাদের ভোটার। এ নিয়ে বচসা থেকে হাতাতাতি। কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দেয়।
বারাবনি ব্লকের পুচড়া পঞ্চায়েতের সিধাবাড়ি এলাকায় সিপিএম প্রার্থীকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখানো হয় বলে অভিযোগ। অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। দাসকেয়ারি প্রাথমিক স্কুলে ১৫৬ নম্বর বুথের সিপিএম প্রার্থী সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। সিদ্ধার্থবাবু জানান, এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ তিনি বুথে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তাঁকে ধরা হয় ও মারধোর করা হয়। সালানপুর ব্লকের বাসুদেবপুর জেমারি পঞ্চায়েতে বাসুদেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ অশান্তি বাধে। বেশ কিছু বহিরাগতকে নিয়ে সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী বুথে ঢোকার চেষ্টা করেন। কংগ্রেস বাধা দেয় বলে অভিযোগ। দু’পক্ষের বচসা হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী গিয়ে তাড়া করে সরিয়ে দেয় তাদের।
কাঁকসার বনকাটি পঞ্চায়েতের বনকাটি ও বসুধার মোট ৬টি বুথ দখলের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ভোট দিতে বুথে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে সিপিএম দাবি করলে দুপুরে দু’পক্ষের সংঘর্ষের উপক্রম হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী গিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দু’পক্ষকে হঠিয়ে দেয়। বেশ কিছু তির-ধনুক উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের জগন্নাথপুরে গোলাম মোর্তাজা নামে এক তৃণমূল কর্মীকে মারধর করা হয়। তিনি মাকে নিয়ে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তাঁকে কয়েকজন সিপিএম কর্মী-সমর্থক মারধর করে বলে অভিযোগ। তাঁকে বাধা দিতে গিয়ে মার খান শেখ জব্বর নামে আর এক তৃণমূল কর্মী। গোলাম মোর্তাজাকে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ কাঁকসার গোপালপুর পঞ্চায়েতের বান্দরা গ্রামে সুজয় পবি নামে এক তৃণমূল সমর্থককে মারধর করা হয়। তাঁর মাথায় চোট লাগে। রাজবাঁধের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। অভিযোগের তির সিপিএমের দিকে। যদিও সিপিএম এই ঘটরা সঙ্গে তাদের যোগ নেই বলে দাবি করেছে। |