রবার্ট গলব্রেইথ। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার। হালে বন্দুক ছেড়ে হাতে কলম ধরেছেন। আর প্রথম বইয়েই বাজিমাত! এপ্রিলে বেরোয় রবার্টের লেখা প্রথম রহস্য উপন্যাস ‘দ্য কাক্কুজ কলিং’। ঝড়ের বেগে ১৫০০ কপি নিঃশেষ। বেস্ট সেলারের তালিকায় উঠে এল বই। নামজাদা লেখকরা বললেন, ‘অসাধারণ শুরু’। কেউ আবার বললেন, এক জন পুরুষ হয়েও নারী চরিত্রের খুঁটিনাটি কী অসাধারণ ব্যাখ্যা করেছেন রবার্ট! এর পরেও কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও জানা যায়নি রবার্ট লোকটাকে দেখতে কেমন। প্রকাশনা সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে মিলেছিল শুধু একটা আলো-আঁধারি সিল্যুয়েট। তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে গোয়েন্দাকাহিনি লেখকের উপরেই এক প্রস্ত গোয়েন্দাগিরি শুরু করে একটি ব্রিটিশ দৈনিক। রীতিমতো সূত্র ধরে ধরে তারা খুঁজে বার করে ফেলে রবার্ট গলব্রেইথের আসল চেহারা।
তার পর খবরটা নাড়িয়ে দেয় গোটা দুনিয়াকে। এই রবার্ট গলব্রেইথ আসলে জে কে রোওলিং! পুরুষের ছদ্মনামের আড়ালে এত দিন সযত্নে নিজেকে ঢেকে রেখেছিলেন হ্যারি পটারের স্রষ্টা।
হগওয়ার্টসের গণ্ডি ছাড়িয়েছিলেন গত বছরই। ‘দ্য ক্যাজুয়াল ভ্যাকেন্সি’ দিয়ে হাত পাকিয়েছিলেন বড়দের উপন্যাসে। বিশাল সাফল্য যে পেয়েছিলেন, এমন বলা যায় না। কিন্তু সে বারও বই প্রকাশের আগে রোওলিংকে ঘিরে ছিল যথেষ্ট হইচই আর উত্তেজনা। এ বার যার ছিটেফোঁটাও ছিল না। ওই যে, লেখককে তো কেউ দেখেইনি।
রহস্য উপন্যাস হলেও ‘দ্য কাক্কুজ কলিং’ও কিন্তু বড়দের জন্য লেখা। লন্ডনের মেফেয়ারে বরফ-ঢাকা ব্যালকনি থেকে পড়ে মৃত্যু হয় এক মডেলের। সেই মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব বর্তায় গোয়েন্দা করমোরান স্ট্রাইকের ওপর। এইখানে গল্পের শুরু। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে রহস্য আরও জমে ওঠে।
কিন্তু উপন্যাসের বাইরে যে রহস্যটা চলছিল, সেখানে রোওলিং কী করে উঠে এলেন সন্দেহ তালিকায়? লেখকের পরিচয় ঘিরে আগাগোড়া রহস্যটা অবশ্যই একটা কারণ। অনেকেই বলছেন, রোওলিংয়ের ছদ্মনামের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তাই। কয়েক বছর আগেই পটারের সাত-সাতখানা উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছে বাচ্চা-বুড়ো সকলেই। বাজারে পড়তে না পড়তেই উধাও হয়ে গিয়েছিল বইগুলো। কাজেই রোওলিংয়ের লেখার ধরন পাঠকদের কাছে অচেনা মোটেই নয়। রহস্য উপন্যাস লেখক মার্ক বিলিংহ্যাম যেমন বললেন, “করমোরান অন্য গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর থেকে এক্কেবারে আলাদা। লেখিকা দারুণ বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চরিত্রটাকে।” অন্য এক ব্রিটিশ লেখক ভ্যাল ম্যাকডারমিড তো আরও সোজাসাপ্টা ভাবে জানিয়ে দিলেন, পড়তে পড়তে রোওলিংয়ের কথা বারবারই মনে পড়ছিল তাঁর। |
প্রকাশনা সংস্থা অবশ্য তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করেছিল, রবার্ট গলব্রেইথ ২০০৩ সালে মিলিটারি গোয়েন্দা পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সূত্র ছড়ানো ছিল আশপাশেই। তদন্তকারী সাংবাদিকরা দেখেন, ‘দ্য কাক্কুজ কলিং’ যে সংস্থা থেকে বেরিয়েছে, সেই একই সংস্থা থেকে বেরিয়েছিল রোওলিংয়ের ‘দ্য ক্যাজুয়াল ভ্যাকেন্সি’ও। আরও একটু অনুসন্ধান করতে দেখা যায়, রোওলিং এবং রবার্টের এজেন্টও একই ব্যক্তি। এর পর আর রবার্ট গলব্রেইথের আসল পরিচয় ভেদ করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি ব্রিটিশ দৈনিকটিকে। কিন্তু রোওলিং যে চেয়েছিলেন তাঁর হ্যারির ‘ইনভিজিবল ক্লোক’-এর মতোই রবার্ট নামের আড়ালে অদৃশ্য থাকতে! ধরা পড়ে গিয়ে তাই খানিক অপ্রস্তুত লেখিকা। বললেন, “আরও কিছু দিন আড়ালে থাকতে চেয়েছিলাম। পাঠকের আমার ওপর কোনও আশা-ভরসা ছিল না। কোনও উত্তেজনা-আড়ম্বর ছাড়াই বই প্রকাশ, নতুন নামে পাঠকের থেকে একেবারে নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া পাওয়া এ এক অন্য অনুভূতি। দারুণ লাগছিল ব্যাপারটা।” কথা প্রসঙ্গে জানালেন, পটারের এক-একটা উপন্যাস বেরোনোর সময় কী বিশাল মানসিক চাপ সামলাতে হত তাঁকে। ‘এ বার কেমন হবে, ছোটদের কেমন লাগবে’ প্রশ্নের শেষ ছিল না। এমনকী পটার-পর্ব শেষ করে ক্যাজুয়াল ভ্যাকেন্সির সময়েও একই অবস্থা। বই প্রকাশের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদার চাপ বেড়েছিল পাল্লা দিয়ে। সে দিক দিয়ে এ বার রবার্টের আড়াল অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছিল লেখিকাকে।
তবে আড়াল সরে গেলেও করমোরান তো হিট। সামনের বছরই বেরোচ্ছে তাঁর গোয়েন্দাগিরির দ্বিতীয় গপ্পো। শুধু লেখিকাকে ফের নামতে হবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধে। যে যুদ্ধের নাম রবার্ট বনাম রোওলিং! |