পানীয় জলকে জীবাণুমুক্ত করতে স্বল্পমূল্যের ‘ওয়াটার ফিল্টার’ তৈরি করল খড়্গপুর আইআইটি-র মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। নাম দেওয়া হয়েছে ‘খড়্গপুর ফিল্টার’। আইআইটির প্রফেসর জয়ন্ত ভট্টাচার্যের দাবি, “এই ফিল্টারের মাধ্যমে ৯৯ শতাংশ শুদ্ধ পানীয় জল পাওয়া যাবে। নলকূপ, কুঁয়ো প্রভৃতি জায়গার জল জীবাণু মুক্ত নয়। এমনকি প্রশ্নাতীত নয় সাধারণ ফিল্টারও। কিন্তু আমাদের ফিল্টারের জল পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তা ৯৯ শতাংশ জীবাণু মুক্ত।”
কেমন ভাবে তৈরি হয়েছে এই ফিল্টার?
জানা গিয়েছে, এই ফিল্টারে আহামরি কোনও প্রযুক্তি নেই। চিরাচরিত, ঘরোয়া পদ্ধতিকে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা তৈরি করা হয়েছে। অ্যালুমিনিয়ামের পাত দিয়ে তিনটি চোঙার মতো পাত্র তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি পাত্রের নীচে ছোট্ট ছোট্ট ফুটো যুক্ত একটি পাত্র রাখা হয়। চোঙার মতো পাত্রের প্রথমটিতে রাখা হয় নুড়িপাথর, দ্বিতীয়টিতে বালি ও তৃতীয়টিতে কাঠকয়লা। প্রথম দুই স্তরের মাঝে গোলাকার ভাবে একটি অ্যালুমিনিয়াম পাত দেওয়া থাকে। যাতে নুড়িপাথর বা বালি ভেদ করে আসা জলের ফোঁটাগুলি তাতে পড়ে ধাক্কা খায় ও একাধিক ফোঁটা তৈরি হয়। এই পদ্ধতিতে গবেষকরা আইআইটির নিকাশী নালা, পুকুর ও পানীয় জল পরীক্ষা করেছিলেন। এক গবেষকের কথায়, জলে যত বেশি পরিমাণ অক্সিজেন থাকবে, জল ততই জীবাণু মুক্ত হবে। কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব? এর উত্তর পেতেই শুরু হয়েছিল গবেষণা। মেলে সাফল্য। দেখা যায়, ফিল্টার করার আগে নিকাশি নালার জলে পিএইচ ছিল ৭.৮৮ মিলিগ্রাম। শোধনের পর তা হয় ৮.৪০ মিলিগ্রাম। পানীয় জলে যেখানে ছিল ৭.৪৩ মিলিগ্রাম সেখানে ফিল্টার করার পর হয় ৮.০১ মিলিগ্রাম। পুকুরের জলের ক্ষেত্রেও তা ৭.৬২ মিলিগ্রাম থেকে বেড়ে হয় ৮.২ মিলিগ্রাম। একই ভাবে এই পদ্ধতিতে বেড়েছে অক্সিজেনের পরিমাণও। নালার জলে প্রথমে যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ৪.২ মিলিগ্রাম, সেখানে শোধনের পরে হয়েছে ৬.৩ মিলিগ্রাম। একই ভাবে বেড়েছে আইআইটিতে সরবরাহ করা পানীয় জল এবং পুকুরের জলের অক্সিজেনের পরিমাণ।
কী ভাবে কাজ করছে ফিল্টার?
বিভাগের তরফে ব্যাখ্যা, ত্রি-স্তরীয় ফিল্টারের দু’টি স্তরে জলের ফোঁটাকে ফেলা হচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের পাতে। এর ফলে একটি ফোঁটা ভেঙে তৈরি হচ্ছে একাধিক ফোঁটা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটায় ঢুকে যায় অক্সিজেন। এ ভাবে অক্সিজেন বৃদ্ধির ফলেই জল জীবাণু মুক্ত হয়। জলে পিএইচের মাত্রাও বাড়ে। জলে থাকা যে সব পদার্থে জীবাণু থাকে সেই পদার্থগুলিও কমে যায়।
এই ফিল্টার তৈরির খরচও কম। আইআইটির মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তরফে দাবি, এর দাম পড়বে বড় জোর সাড়ে ৮০০ টাকা। তা ছাড়াও এই ফিল্টারের জন্য লাগবে না বিদ্যুৎ। সাধারণ ফিল্টারের ক্যাণ্ডাল পরিবর্তন করতে হয়। তার জন্যও খরচ রয়েছে। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে সেই খরচও নেই। তবে বহু ব্যবহারের পর খারাপ জল বার হলে পরিষ্কার জলে নুড়িপাথর, বালি ও কাঠকয়লাগুলি শুধু ধুয়ে নিতে হবে। তাদের দাবি, গরিব বস্তি এলাকায়, বন্যা প্লাবিত এলাকায়, স্কুলে মিড-ডে মিলের জন্য প্রয়োজনীয় জল পরিস্রুত করতে এই ফিল্টার খুবই কাজে দেবে। কয়েকটি স্কুলে কিছু দিনের জন্য এই ফিল্টার দিয়ে পরীক্ষাও করেছেন গবেষকেরা।
যেমন খড়্গপুরের আমড়াকোলা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে ওই পরিশোধক যন্ত্র রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রের সহায়িকা রাখি বিশ্বাসের কথায়, “ভীষণ ভাল। আমাদের নলকূপের জল খুবই নোংরা। বাচ্চাদের বাড়ি থেকে জল আনতে হত। কিন্তু ওই ফিল্টার পাওয়ার পর, সেই জলে রান্না করা হত। ছেলেরা খেত। ভীষণ উপকার হয়েছিল।” তবে তাঁর আক্ষেপ, “ওরা তো পরীক্ষার জন্য রেখেছিল। আবার নিয়ে চলে গিয়েছে। ফলে ফের সমস্যায় পড়েছি।” মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তরফে তাই জানানো হয়েছে, “সরকার বা কোনও সংস্থা এই ফিল্টার তৈরি করে সাধারণ গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে আমরা সাহায্য করব। তাতে সকলেই উপকৃত হবেন। পেটের রোগ কমবে। মানুষের স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে।” |