খরবটা শুনে থমকে গিয়েছিলেন দিব্যেন্দু রায়!
অবসরের আট বছর পরেও জীবনের গতি মোটামুটি একই আছে। ভোরে হাঁটা, শারীরিক কসরৎ, লাফিং ক্লাবে হাসির ব্যয়াম সবই চলছে নিয়ম মেনে। স্রেফ একটা বায়পসি রিপোর্টই সব শেষ করে দেবে?
মানতে পারেননি আটষট্টিতে পা রাখা অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী। গাঙ্গুলিবাগানের রায়বাড়িতে যদিও তখন শোকের ছায়া। হবেই বা না কেন? বায়পসি রিপোর্ট যে বলছে, প্রস্টেট ক্যানসার একেবারে শেষ পর্যায়ে, পোশাকি ভাষায় ‘স্টেজ-ফোর!’ এমনকী, প্রস্টেট থেকে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে শিরদাঁড়ার হাড়ে। সংক্রমণ ঠেকাতে তিনটে ভার্টিব্রা বাদ দিতে হয়। হতাশ পরিজনেরা দিন গুনতে শুরু করেন।
অন্য দিকে, নতুন চিকিৎসার হাত ধরে দিব্যেন্দুবাবু শুরু করেন নতুন লড়াই। যা এই তিয়াত্তরেও জারি রয়েছে। দিব্যেন্দুবাবু হাঁটছেন, হাসছেন, দিল্লি-মুম্বই ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রায় অবলীলায়! চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ওঁঁর শরীর থেকে ক্যানসার পুরোপুরি বিদায় না-নিলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে রয়েছে। এবং এ ভাবেই স্বাভাবিক মানুষের মতো বেশ কিছু দিন তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন। |
রেডিওথেরাপি নয়, কেমোথেরাপি-ও নয়। তবে কোন জাদুবলে শরীরের মধ্যে প্রস্টেট ক্যানসারকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে?
প্রস্টেট ক্যানসারের শেষ পর্যায়ের রোগীদের টেস্টিস পুরোপুরি বাদ দেওয়া যেতে পারে। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, এ ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ রাখার সেরা দাওয়াই হল হরমোন থেরাপি। সেটাই ম্যাজিকের মতো কাজ করে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এক ধরনের হরমোন রোগীর দেহে প্রয়োগ করতে হয়, প্রতি তিন থেকে ছ’মাস অন্তর। প্রতি বারের খরচ ১২-১৩ হাজার টাকা। এতে কাজ হয় কী ভাবে?
দিব্যেন্দুবাবুর চিকিৎসক ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষের ব্যাখ্যা: পুরুষ শরীরে টেস্টিস থেকে টেস্টোস্টেরন নামে পুরুষ-হরমোন ক্ষরণ হয়। এই টেস্টোস্টেরন প্রস্টেটে ঢুকে তার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অনেক সময়ে সেই ক্ষরণ মাত্রা ছাড়ালে প্রস্টেটও বাড়ে মাত্রা ছাড়িয়ে। এই টেস্টোস্টেরনই প্রস্টেটে ক্যানসার সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগায়। তাই টেস্টোস্টেরনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রস্টেটে তার প্রবেশ আটকাতে পারলে প্রস্টেট ক্যানসারে লাগাম দেওয়া সম্ভব। হরমোন থেরাপিতে সেটাই করা হয়। প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্তের দেহে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টি-টেস্টোস্টেরন হরমোন ঢুকিয়ে টেস্টোস্টেরনের ক্ষরণ যেমন কমানো হয়, অন্য দিকে প্রস্টেটের দেওয়ালে তৈরি করা হয় একটি স্তর, যা ভেদ করে ভিতরে টেস্টোস্টেরন ঢুকতে পারে না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই পদ্ধতি শুধু প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসায় প্রযোজ্য, অন্য ক্যানসারের ক্ষেত্রে নয়। |
এবং এই হরমোন থেরাপির সৌজন্যেই দিব্যি রয়েছেন দিব্যেন্দুবাবু। তাঁর প্রায় সুস্থ মানুষের মতো বেঁচে থাকাটা কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনাও নয়। চিকিৎসক অমিতবাবুর কথায়, “প্রস্টেট ক্যানসার সাধারণত একটু বেশি বয়সে হয়। বিশেষত ষাটের পরে। ক্যানসার শব্দটার মধ্যে একটা মৃত্যুর হাতছানি রয়েছে। প্রবীণেরা মনে করেন, এই বয়সে কাটা-ছেঁড়া বা ওষুধ খেয়ে পয়সা খরচ করে কী লাভ! অথচ সত্যিটা হল, দেরিতে ধরা পড়লেও ঠিক চিকিৎসায় প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ জীবন কাটাতে পারেন যে কেউ।”
যেমন কাটাচ্ছেন আলিপুরের চেতন শিবদাসানি কিংবা বেকবাগানের দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়।
দু’জনেই ষাট পেরিয়েছেন। চেতনবাবুর প্রথমে প্রস্রাবে অসুবিধা হতো। ব্যথা না-হলেও অল্প রক্ত পড়ত। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, স্টেজ-থ্রি ক্যানসার। ধরেই নিয়েছিলেন, মারা যাবেন। কিন্তু তিন বছর পরেও রোগ দমিয়ে রেখে দিব্যি আছেন। পারিবারিক ব্যবসাও সামলাচ্ছেন। আর অবসরপ্রাপ্ত সেল্স ট্যাক্স-কর্মী দেবদত্তবাবুর মূল সমস্যা ছিল কোমরে যন্ত্রণা। ভেবেছিলেন বাত, ধরা পড়ল প্রস্টেট ক্যানসার। স্টেজ-ফোর। তার পরে ছ’বছর কেটেছে। চিকিৎসকদের দাবি, নিয়মিত ওষুধে তাঁর অসুখ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
প্রস্টেট ক্যানসার হয়েছে বোঝা যাবে কী করে? সহজ উপায় হল রক্তের একটি পরীক্ষা করা। যার নাম প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন (পিএসএ) টেস্ট। প্রস্টেট ক্যানসার হলে রক্তে এই অ্যান্টিজেনের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তাই বয়স পঞ্চাশ হলেই পুরুষদের বছরে এক বার পিএসএ যাচাই জরুরি বলে চিকিৎসকদের অভিমত। “এতে প্রস্টেট ক্যানসার হয়ে থাকলেও প্রথম চোটে ধরা পড়বে। চিকিৎসার খরচও হবে অনেক কম।” বলছেন তাঁরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র রিপোর্ট বলছে, সারা বিশ্বে পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন প্রস্টেট ক্যানসারে। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি। ‘ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ক্যানসার নেটওয়ার্ক’-এর ২০১১-র সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে একটা সময়ে এর প্রকোপ কম থাকলেও এখন আক্রান্তের হার বছরে ১% হারে বাড়ছে। মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট মধুছন্দা কর বলেন, “আগে প্রস্টেট ক্যানসারের রোগী কম আসতেন। এখন প্রায় রোজ অন্তত একটা কেস পাচ্ছি। অধিকাংশই স্টেজ-ফোর।” একই বক্তব্য ইউরোলজিস্ট সত্যদীপ মুখোপাধ্যায়ের “রোবোটিক সার্জারির মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসা এখন এসে গিয়েছে। একটু সতর্ক হলে প্রথম স্টেজেই প্রস্টেট ক্যানসার ধরা পড়ার কথা এবং তাতে এক জনেরও মারা যাওয়ার কথা নয়।”
চিকিৎসকেরা বলছেন, ক্যানসার-কূলে প্রস্টেট ক্যানসার যেন এক অন্য গ্রহের বাসিন্দা। সেখানে জীবন দ্রুত ফুরোয় না। লড়াইয়ে টেকার পুরো সুযোগ পান রোগী। এতে মৃত্যুভয়ের জায়গা কম। এমনকী, স্টেজ ফোরেও ‘কোয়ালিটি লাইফ’ কাটানো যায়।
দিব্যেন্দু রায়, দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়, চেতন শিবদাসানিদের উদাহরণ টেনে সেই বার্তাই দিয়ে চাইছেন ক্যানসার-বিশেষজ্ঞেরা। |