কলকাতার উপকণ্ঠে একটি বৃদ্ধাবাসেই দেখা হয়েছিল দু’জনের। এক জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, অন্য জন প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা। বিপত্নীক প্রবীণ ও ঝাড়া হাত-পা প্রৌঢ়া। দু’জনেই গানবাজনা ভালবাসেন। ভদ্রলোকের ছানির সমস্যায় এটা-সেটা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন মহিলা। দানা বাঁধে সম্পর্ক। বাকি জীবনটা একসঙ্গে থাকবেন বলে এখন অন্য একটি বৃদ্ধাশ্রমে উঠে গিয়েছেন দু’জনে।
মুম্বইবাসী ৬৩ বছরের রেবা মুখোপাধ্যায় বিয়ে করে থিতু হতে চাইছেন। যত দিন মা-বাবা বেঁচে ছিলেন, ভাইবোন ছোট ছিল, নিঃসঙ্গতা টের পাননি। এখনও জিম করে বা বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়দের সঙ্গে গল্প করে সময় কেটে যায়। তবু সন্ধের পরে নিজের ফ্ল্যাটটা খাঁ-খাঁ করে। তাই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে নিজের বর খুঁজতে নেমেছেন প্রাক্তন শিক্ষিকা রেবাদেবী।
প্রৌঢ়ত্ব মানে এঁদের কারও কাছেই জীবনের শেষ নয়, বরং নতুন করে শুরু। “তুমি আকাশ এখন যদি হতে, আমি বলাকার মতো পাখা মেলতাম,” বলে স্বপ্ন দেখা শুধু নয়, এটা সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার যুগ। |
বৃদ্ধ কিন্তু মনে তরুণ। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবে ফ্যাশন প্যারেড। |
ভারতে বার্ধক্য |
২০০১: ৭.০৭ কোটি (৭.৫%)
২০১১: ৯.০৬ কোটি (৮.২%)
২০২১: ১৩.৩ কোটি (৯.৯%) |
সূত্র: জনগণনা দফতর, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অগানাইজেশন |
রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, ৭% এর ষাটোর্ধ্ব নাগরিক থাকলেই সেই দেশ বয়স্কদের দেশ সাব্যস্ত হবে। |
|
ডোভার লেনের সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, কাঁকুলিয়া রোডের আলপনাদেবী বা ঢাকুরিয়ার গায়ত্রী দাসশর্মার জীবনেও প্রতিটি দিনই নতুন দিন। ৭৪ বছরের গায়ত্রীদেবীর স্বামী প্রয়াত হয়েছেন। মেয়ে কলকাতায় থাকলেও, ছেলে নরওয়েবাসী। বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে কবিতা লেখার চর্চায় নিজেকে আবিষ্কার করেছেন গায়ত্রী। লেখা ছাপাও হচ্ছে ছোটখাটো পত্রিকায়। বিবাহবিচ্ছিন্না ৭০ ছুঁই ছুঁই আলপনাদেবী আগে আমেরিকায় চাকরি করতেন। এখন দেশে ফিরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে সমাজসেবার নানা ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। তাতেই খুঁজে নিচ্ছেন আনন্দ।
৬৬ বছরের সুব্রতবাবুরও ‘অবসর’ জীবনে মন নেই। একাই থাকেন। তাঁর থেকেও প্রবীণ, অশক্ত মানুষদের সাহায্যে দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ান। কী রকম? ৯০ বছরের এক বৃদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামী আত্মজীবনী লিখতে চান। কিন্তু লিখতে বসে হাত কাঁপে। অনুলেখক হয়ে হাজির সুব্রতবাবু। পরিবারে কোণঠাসা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পারিবারিক সমস্যা মেটাতেও সাধ্য মতো চেষ্টা করেন তিনি।
অর্থাৎ? বার্ধক্য মানে মোটেই আর লাঠি হাতে থুরথুরে চেহারা নয়। ষাট বছর বয়সে চাকরিজীবন শেষ হলেও আধুনিক জীবনধারায় শারীরিক এবং মানসিক শক্তি অনেকটাই অটুট থাকে। সুতরাং রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞা যতই ষাট পেরোলে বৃদ্ধ বলুক, আজকের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখাতেই ভালবাসছেন।
৭৭ বছরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রোজ ডন-বৈঠক দিয়ে শরীর-চর্চা করেন। তাঁর থেকে সামান্য ছোট চুনী গোস্বামীও ইচ্ছেমতো টেনিস-ক্রিকেট খেলে থাকেন। শীর্ষেন্দু বলছেন, “আমি বাজারহাট করি, মর্জিমাফিক ঘুরে বেড়াই! ছেলেমেয়েরা চিন্তা করলে বকুনি দিই, একদম আমায় বুড়ো বানাবি না!”
চুনীর কথায়, “মন ভাল রাখতে কখনও একটু খেলি-টেলি, ক্লাবের আড্ডায় একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করি, ছোটদের সঙ্গেও খোলা মনে আড্ডা দিই। বুড়ো হতে আমার বয়ে গিয়েছে।” বয়স ভোলার এই প্রবণতাকে মুক্ত কণ্ঠে স্বাগত জানাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব তন্বী অলকানন্দা রায়। তবে তাঁর মতে, শুধু একটা সম্পর্কের আশ্রয় নয়, নিজের প্রতিভার বিকাশ বা ভেতরের মানুষটাকে চিনতে পারাই আসল কথা। “সব মানুষের মধ্যেই প্রতিভার গিফ্ট-প্যাকেজ থাকে। কম বয়সে নানা চাপে কারও হয়তা সেটা খুলেই দেখা হল না। বার্ধক্যে পৌঁছে সেটা খোলার অবসর মিলতে পারে।” ব্যস্ত নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা নিজেই এখন বর্ষীয়ান নাগরিকদের একটি সংগঠনের ব্র্যান্ড-অ্যাম্বাসাডর। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন শহরেই এখন বয়স্কদের মেলামেশার কিছু পরিসর গড়ে উঠছে। ডিগনিটি ফাউন্ডেশন বলে একটি সংস্থা যেমন মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতা বা বেঙ্গালুরুতে নিয়মিত আড্ডা বা চা-চক্রের আয়োজন করছে। |
শীর্ষেন্দু
মুখোপাধ্যায় |
বিজয় মৈত্র |
চুণী গোস্বামী |
|
মাঝেমধ্যেই বসছে বয়স্কদের কম্প্যানিয়নশিপ কার্নিভাল। সেখানে দাদু-দিদারা দল বেঁধে হাউজি খেলছেন। কিংবা খেটেখুটে রীতিমতো মহড়া দিয়ে ফ্যাশন শোয়ে র্যাম্পে হাঁটছেন। আলোচনাসভায় উঠে আসছে বৃদ্ধদের বিয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও। ‘চিনি কম’-এর গল্প আর শুধু পর্দায় আবদ্ধ নেই। আমদাবাদের একটি সংস্থা সম্প্রতি বিবাহেচ্ছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য পাকাদেখার আয়োজন করেছে। ‘বিনামূল্য অমূল্য সেবা’ নামে সংস্থাটির উদ্যোগে এক দশকে ৫০-৬০টি বিয়ে হয়েছে। এ বার কলকাতাতেও আসার তোড়জোড় করছে সংস্থাটি।
প্রবীণদের জীবনবোধ যে পাল্টাচ্ছে, ডায়েটিশিয়ান বা ফিটনেস-বিশারদেরাও সেটা ভালই টের পাচ্ছেন। পঞ্চাশে বাণপ্রস্থ এখন অবান্তর! “সুস্থ-নীরোগ জীবনের জন্য ৭৫-৮০তেও অনেকেই জেদ করে ১৫-২০ কেজি ওজন কমাচ্ছেন। তরুণদের ছাপিয়ে, ৫৫-৬৫ বছরের সচেতন নাগরিকরাই দলে দলে আসছেন,” বলছেন ডায়েটিশিয়ান রেশমি রায়চৌধুরী। কন্ডিশনিং কোচ রণদীপ মৈত্রর জিমেও ‘সিনিয়র সিটিজেন’দের ভিড়। রণদীপ বলছিলেন তাঁর বাবা প্রাক্তন রঞ্জি ক্রিকেটার বিজয় মৈত্রর কথা। “৮০ বছরেও বাবা নিয়মিত ভাল হুইস্কি মেপে খাচ্ছেন। আবার সকালে গল্ফে কামাই নেই।”
বিজয়বাবুর কথায়, “আগে বয়স্কদের কীর্তন শুনতে যেতে দেখতাম। আমার জীবনে গল্ফই কীর্তন।”
প্রবীণদের এই নতুন কিছু করার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্মিত নন বার্ধ্যক্যবিজ্ঞান বিশারদ (জেরন্টলজিস্ট) ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, “মানুষের জীবনের মেয়াদ যখন বাড়ছে, তখন ভাল ভাবে বাঁচার ইচ্ছেটাও তো বাড়বেই।” দুনিয়া জুড়েই চিকিৎসার উন্নতি ও রকমারি জীবনদায়ী ওষুধের হাত ধরে ক্রমশ বাড়ছে বয়স্কদের সংখ্যা। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ষাটোর্ধ্বরা ১৪ বছরের কমবয়সীদের থেকে দলে ভারী হবেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে সব থেকে এগিয়ে ৮০ বছরের বেশি বয়সীরা। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। ইউনাইটেড নেশনস ফান্ড ফর পপুলেশন-এর রিপোর্ট বলছে, ২০৫০-এর মধ্যে ভারতে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলবে (বর্তমানে ওই অনুপাত ৮ শতাংশ)। জেরন্টলজিস্টদের পর্যবেক্ষণ, আগে সমাজে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মুষ্টিমেয় ছিলেন বলেই তাঁদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে লোকে তত মাথা ঘামাত না। “বিদেশে তো বলেই, লাইফ বিগিনস অ্যাট সিক্সটি। এখন আমরাও ক্রমশ এটা বুঝছি,” বলছেন ইন্দ্রাণী।
কিন্তু প্রবীণদের এই জীবনীশক্তি সমাজের কাজে কতটা লাগানো যাচ্ছে? পরিসংখ্যানবিদদের মতে, ভারতে যে কোনও ৬০ বছর বয়সীর আরও ১৮-১৯ বছর বাঁচার সম্ভাবনা থাকেই। উন্নত দেশ অতএব স্লোগানটা বদলে নেওয়ার সময় এসেছে। আশিতে আসুন! |