রফতানির বাজারে লম্বা, সরু, সুগন্ধি জাতের ধানের কদর ছিলই। এ বার মোটা চালও আর পড়ে থাকছে না। আফ্রিকা এবং আরবের দেশগুলোতে মোটা চালের রফতানি ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আর তাতেই বাংলার ধানচাষি দুটো পয়সার মুখ দেখতে শুরু করেছে। ধানের দাম বাড়ছে এই মরা মরসুমেও।
মধ্যবিত্ত বাঙালি পাতে তুলতে চান না বলে মোটা চালের চাহিদা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু গত বছর কেন্দ্র চাল রফতানির উপর যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়। ২০১২-র ফেব্রুয়ারি মাসের আগে পর্যন্ত বাসমতি ছাড়া অন্য যে কোনও রকম চাল রফতানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে চাল রফতানির গোটা বাজারটাই ছিল উত্তর ভারতের বাসমতি উৎপাদক রাজ্যগুলোর দখলে। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় এখন বাসমতীর কিছু জাতের চাল ছাড়া আর কোনও ধরনের চাল রফতানিতে ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না। এর ফলে বাংলার ধানি জমিতে হঠাৎই সুবাতাস বইতে শুরু করেছে।
চালের রফতানির বাজার মুক্ত হওয়ায় প্রায় সবটুকু সুযোগ আগেভাগেই নিতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গ। ঠিক কতটা চাল রফতানি হচ্ছে তার অনুপুঙ্খ হিসেব না দিতে পারলেও কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘গত জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসে ৪৪ হাজার টন চাল রফতানি হচ্ছে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ ছাড়া উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা এবং আরবের বিভিন্ন দেশে চাল রফতানি হচ্ছে। তার বেশিরভাগটাই মোটা চাল। আতপ এবং সিদ্ধ দুই রকম চালই রফতানি হচ্ছে।’’ |
বর্ধমানের চাল ব্যবসায়ী ঘনশ্যাম অগ্রবাল জানালেন, কেবল বর্ধমান থেকেই প্রতিদিন দুই হাজার টন চাল বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তার মধ্যে ‘স্বর্ণ মাসুরি’র মতো মোটা জাতের চালও যেমন আছে, তেমনই আছে বাদশাভোগ, সুগন্ধা, গোবিন্দভোগ, সীতাভোগ, কামিনীভোগ, তুলাইপাঞ্জি, রাঁধুনিপাগলর মতো সরু, লম্বা, সুগন্ধী জাতের চাল। রফতানির বাজারে আতপের চাহিদা বেশি হলেও সিদ্ধ চালও রফতানি হচ্ছে। ফলে চালের দাম অনেকটাই বেড়েছে। তিন মাস আগেও স্বর্ণ মাসুরির মতো মোটা জাতের ধান ৬৭০/৮০ টাকায় (৬০ কেজি) বিক্রি হয়েছে। এখন তার দাম ৮২০ টাকা। দাম ক্রমেই বাড়ছে। আর সরু, লম্বা, সুগন্ধি জাতের ধানের দাম তো আনেক আগে থেকেই চড়া।
কিন্তু এই ভাবে রাজ্য থেকে যথেচ্ছ চাল রফতানি কতে গিয়ে ঘরের চালে টান পড়বে না তো?
তেমনটা মনে করছেন না মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের আশা আগামী মরসুমে ধানের ‘বাম্পার’ ফলন হবে। তাছাড়া রফতানির ফলে রাজ্যের বাজারে চালের দাম অত্যধিক বেড়ে গেলে সেই সব সম্পন্ন-মধ্যবিত্তরা অসুবিধায় পড়তে পারেন যারা অন্ধ্র বা মহারাষ্ট্র থেকে আমদানি করা দামি চাল খান। তবে গরিব মানুষের কোনও অসুবিধা হবে না। কারণ, আমরা রেশনে দেওয়ার মতো যথেষ্ট চাল সংগ্রহ করে রেখেছি।’’
অনেক দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ ধান উৎপাদনে দেশে প্রথম। সরকারি হিসেব মতো চলতি বছরে রাজ্যে ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। আর রাজ্যে ধানের চাহিদা ১৩৮ লক্ষ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এতে মরসুমের গোড়ায় ধানের দাম কমে গিয়েছিল। সরকারের বক্তব্য ছিল, বাড়তি উৎপাদনের ফলে চাষি ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। মোটা ধানের বাড়তি উৎপাদনের ফলেও সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে চাষিকে। মোটা চাল রফতানি শুরু হওয়ায় অবশ্য ধানের এই বাড়তি উৎপাদনই শুভ হয়ে উঠছে। রাজ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি জমিতে মোটা ধানের চাষ হয়। ‘স্বর্ণ’ জাতের মোটা ধানের চাষই বেশি। অথচ এর বাজার ছিল না। চাষিরাই জানালেন, মোটা ধানের চাহিদা এতই কম ছিল, যে কয়েক মাস আগেও অনেক জায়গাতেই ধানের অভাবি বিক্রি হয়েছে।
আগামীতে এই সমস্যা মিটতে চলেছে। নাইজিরিয়া, মাদাগাসকার, বেনিন, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা দুবাই, মাসকাট, সৌদি আরবে রফতানির কল্যাণে ঘুরে দাঁড়াতে চলেছে বাংলার ধানচাষি। প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘অনেক দিন পরে চাষি কিছু পয়সার মুখ দেখতে পাচ্ছে। যে করেই হোক এই অনুকূল অবস্থাটা ধরে রাখতে হবে।’’ |