ইতিমধ্যেই প্রতি বাড়িতে তিন বার করে ঘোরা সারা। তবু থামতে ভরসা পাচ্ছেন না তিনি।
হাতে তো আর সময় নেই। তার মধ্যেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে আরও এক বার করে মুখ দেখিয়ে নিয়েছেন নীলিমা দেবনাথ। কোনও-কোনও বাড়িতে দরজা খুলতে দেরি হয়েছে কর্তা-গিন্নির। তাতে ধৈর্য হারানোর প্রশ্ন নেই। হাসিমুখে অপেক্ষা করেছেন, দরজা ফাঁক হতেই হাতজোড় করে বলেছেন, “আবার এক বার এলাম। ভোটটা দেবেন কিন্তু।”
লোকে তাঁকে রাজনীতির ময়দানে বেশি দেখেননি। কিন্তু পরিচয়টা যে গেরেমভারি রাজ্যের বস্ত্র ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্প প্রতিমন্ত্রী তথা বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথের স্ত্রী তিনি। বর্ধমানেরই পূর্বস্থলী ১ ব্লকের শ্রীরামপুরে ছোটকোবলা গ্রাম পঞ্চায়েতে জীবনে প্রথম বার প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর স্বামীই পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক। তাতেও ছোটকোবলা গ্রামেই বাড়ি স্বপনবাবুর। তবু নীলিমার স্বস্তি নেই। |
গত বার, ২০০৮ সালেও ছোটকোবলার ওই আসনে জিতেছিল তৃণমূল। এ বার আসনটি মহিলা সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছে। গ্রামে ভোটার ১০৮৬ জন। সেখানে নীলিমাদেবীকে প্রার্থী করার জন্য স্বপনবাবুকে ধরেন বুথস্তরের দলীয় কর্মীরা। কিন্তু দলের একাংশ চেয়েছিলেন, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদেই প্রার্থী করা হোক নীলিমাদেবীকে। শেষমেশ অবশ্য পঞ্চায়েতেই দাঁড়ান স্কুল শিক্ষিকা নীলিমাদেবী। তাঁর কথায়, “স্বামীকে তো খুব কাছ থেকে দেখেছি। ইচ্ছা ছিল, ওরই মতো মানুষের ভালবাসা পাওয়ার। তাই সবাই যখন বলল, প্রার্থী হতে হবে, ফেরাতে পারিনি।”
পরনে কমলা-সবুজ পাড়, জোড়াফুল ছাপ শাড়ি। পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল প্রার্থী জবা মান্ডিকে সঙ্গে নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন তিনি। শুধু নিজের জন্য নয়, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিন তৃণমূল প্রার্থীর জন্যই গলা ফাটিয়েছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, এর আগে দলের কয়েকটি শিবিরে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। প্রচারে তাঁর সঙ্গে ঘুরেছেন দলের প্রমীলা বাহিনীও। যেখানেই যে যা সমস্যার তুলেছে, আশ্বাস দিয়েছেন, সব ঠিক করে দেবেন। স্থানীয় তাঁতি ভাসান দাসের বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী জানান, স্বামী অসুস্থ। তাই ভোট দিতে তো যেতে পারবেন না। নীলিমাদেবী দলীয় কর্মীদের বলে দেন, তাঁকে বুথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করতে।
“দেখে কে বলবে, রাজনীতির সঙ্গে ওঁর কোনও যোগাযোগই ছিল না” বলছেন মুগ্ধ জবা। রাজনীতির সঙ্গে নীলিমার অবশ্য ‘পরোক্ষ’ যোগাযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। সেই যোগাযোগের নাম স্বপন দেবনাথ। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন স্বপনবাবু। সেই সময় থেকে নীলিমাও তাঁর সঙ্গে। কিন্তু এর আগে চুল ভেজাতে সরাসরি জলে নামেননি স্থানীয় ভবতারিণী রায় বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নীলিমা। মায়ের রাজনীতিতে নামা নিয়ে বড় ছেলে জয় মৃদু আপত্তি তুললেও তিনি তাতে আমল দেননি।
হাসি মুখে এলাকার তৃণমূল কর্মী মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ বলেন, “জেলা সভাপতি হওয়ার পরে স্বপনদার ব্যস্ততা এত বেড়েছে যে নিজের এলাকায় প্রচারের ইচ্ছা থাকলেও ফুরসত মেলে না। আমাদের উপরেই ভোটের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এ বার বৌদি ওঁর অভাব অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছেন।” স্বপনবাবুর বন্ধু প্রাণগোপাল মজুমদার যোগ করেন, “ব্যানার, পোস্টার বা ফেস্টুন টাঙানো থেকে শুরু করে সবেতেই ওঁর উত্সাহ দেখার মতো। কার স্ত্রী, দেখতে হবে তো!” স্বপনবাবু বলেন, “এত দিন ও আমার সব কাজে পিছন থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে। আশা করব, নতুন ভূমিকাতেও সফল হবে।”
নীলিমাদেবীর বিরুদ্ধে রয়েছেন সিপিএমের কৃষ্ণা ধুলা, বিজেপি-র পুষ্প দেবনাথ। তাঁরা মন্ত্রীর স্ত্রীকে এক চুলও জায়গা ছাড়তে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য, নানা অনুন্নয়নের কথা তুলে ধরেই প্রচার চালানো হয়েছে। মন্ত্রী-পত্নীর লড়াই সহজ হবে না।
কোন পুষ্প কখন ধুলোয় লুটায়, তা বোধ হয় জানে কেবল বর্ষার মেঘ ছেঁড়া নীলিমা। |