ছিল না ভোট বয়কটের ডাক। বছর দুই আগের সেই মাওবাদী জুজুও নেই। তাই পুরনো আতঙ্ক কাটিয়ে বৃহস্পতিবার রাজ্যের অষ্টম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মাওবাদী ভ্রুকুটি উপেক্ষার ছবিই দেখা গেল দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের প্রতিটি বুথে। একই ছবি ধরা পড়ল পুরুলিয়ার বান্দোয়ানেও। তবে সেখানে একটি জায়গায় ল্যান্ডমাইন পোঁতা রয়েছে বলে আতঙ্ক ছড়ালে জওয়ানেরা গিয়ে দেখে কৌটোর মধ্যে প্লাস্টিকের দড়ি রয়েছে।
নিরাপত্তার কড়া নজরদারির মধ্যে এ দিন সকাল থেকেই মাওবাদী অধ্যুষিত বাঁকুড়ার বারিকুল, রানিবাঁধ, সারেঙ্গা ও রাইপুর থানা এলাকার ‘অতি স্পর্শকাতর’ বুথেও মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে। অশান্তি হয়নি। মৃদু রোদ আর মাঝে মাঝে বৃষ্টির মাঝেও ভোট এগিয়েছে মসৃণ গতিতে। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সারেঙ্গা, বারিকুল, রানিবাঁধ ও রাইপুর থানা এলাকায় একের পর এক মাওবাদী নাশকতার ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে বারিকুলের মাজগেড়িয়ায় মাওবাদীদের রাখা ব্যাগ বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত। এরপর ওই এলাকায় ধারাবাহিকভাবে সিপিএমের আরও কয়েকজন নেতা-কর্মীকে খুন করেছিল মাওবাদীরা। একই ভাবে ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ-মাওবাদী গুলির লড়াইয়ে সারেঙ্গা থানার আইসি রবিলোচন মিত্র নিহত হয়েছিলেন। রানিবাঁধ ও রাইপুরে মাওবাদীদের হাতে সিপিএমের একাধিক নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। |
তবে গত কয়েক বছর ধরে জেলার জঙ্গলমহলে মাওবাদী নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। তবুও ভোটে মাওবাদীরা হামলা চালাতে পারে এই আশঙ্কায় যথেষ্ট নিরাপত্তার আয়োজন করেছিল প্রশাসন। আর প্রশাসনের প্রতি আস্থা যে বাড়ছে ভোটারদের দীর্ঘ লাইনে তারই প্রমাণ মিলেছে। এক সময়ের মাওবাদীদের আঁতুড়ঘর রানিবাঁধ ব্লকের বাঁশডিহা প্রাথমিক স্কুলে (বুথ নম্বর ৩৩) সকাল ৯টায় ভোটারদের লম্বা লাইন। প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা অতুলা সিংহ সর্দারকে মোটরবাইকে চাপিয়ে ভোট দিতে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর নাতি। বৃদ্ধাকে দেখেই হাত ধরে বুথের ভিতরে নিয়ে গেলেন দুই নিরাপত্তারক্ষী। অতুলাদেবী বললেন, “গতবার ভোট দিতে আসার সময় গা ছমছম করছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গিয়েছে।” শুধু বাঁশডিহা গ্রাম নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি সীমানা লাগোয়া বারিকুলের সাতনালা, ধজুড়ি, মাজগেড়িয়া গ্রামে যেখানে দিন-দুপুরে মাওবাদীরা প্রকাশ্যে হুঙ্কার দিত, সেই গ্রামেও এ দিন ছবিটা ছিল অন্য রকম। ওই সব এলাকায় সিপিএমের পাশাপাশি তৃণমূল, ঝাড়খণ্ড পার্টির পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার চোখে পড়েছে।
ফুলঝোড় গ্রামের বিজয় মুর্মু, সাতনালা গ্রামের অগস্তি পাল বলেই ফেললেন, “গত পঞ্চায়েত ভোট, লোকসভা ভোট না দেওয়ার জন্য বনপার্টির লোকেরা ফতোয়া দিয়েছিল। এবার ওদের কেউ আসেনি তাই নিশ্চিন্তে ভোটটা দিতে পারলাম।” এ দিন দুবরাজপুর বুথে ভোট দিতে আসেন মাওবাদী স্কোয়াড লিডার রঞ্জিত পালের মা অলকা পাল, বাবা সত্যনারায়ণ পাল ও ভাই হরিপদ পাল। অলকাদেবী বলেন, “ছেলের পার্টি কী বলবে আমি জানি না। ওর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগও নেই। তবে আমরা সবাই ভোট দিয়েছি।” সাতনালা বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সুনীলকুমার মুর্মু জানালেন, ‘৯১০ জন ভোটারের মধ্যে দুপুর ১২টার মধ্যে ৩০০ জনের বেশি ভোট দিয়েছেন।” জনগণের কমিটির অবরোধ আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল সারেঙ্গার গড়গড়িয়া, বেলেপাল, মাজুরিয়া, মাকরকোল, বেজডাঙা, খয়েরপাহাড়ি, বিক্রমপুর, তেলিজাত এলাকায়। এ দিন ওই সব এলাকায় সব দলেরই পতকা, ফেস্টুন দেখা গিয়েছে। প্রায় প্রতিটি বুথেই সশস্ত্র পুলিশ ছাড়াও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দেখা গিয়েছে। রাস্তায় টহল দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী।
দক্ষিণ বাঁকুড়ার মতো বৃহস্পতিবার বান্দোয়ান শান্তির আবহে ভোট দেখল। মাঝখানে বোমাতঙ্কে খানিকটা ছন্দপতন ঘটেছিল। মাওবাদীদের হাতে নিহত রবি করের বাড়ি বান্দোয়ানের ভোমরাগোড়ায় ঢোকার মুখে একটি কালভার্টের নীচে ল্যান্ডমাইন পোঁতা রয়েছে বলে আতঙ্ক ছড়ায়। বেলা ১১টা নাগাদ জওয়ানরা সেখান থেকে খানিকটা প্লাস্টিকের দড়ি কৌটো বার করে। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “ওখানে ভয় পাওয়ার মতো বস্তু কিছু ছিল না। আতঙ্ক ছড়ানোর মতো কিছু ঘটেনি।”
এ দিকে, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বান্দোয়ানের শিরকা বুথ থেকে ফেরার পথে জওয়ানদের একটি গাড়ি মাওবাদীরা উড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে ঘটনাস্থলেই এক জওয়ান মারা গিয়েছিলেন। অতি স্পর্শকাতর বুথ হিসাবে চিহ্নিত ওই বুথ ও গ্রামের পাশে মঙ্গলবার সকাল থেকেই রুটটমার্চ করে বাহিনী। বৃহস্পতিবার ওই রাস্তায় জওয়ানদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। দুপুর আড়াইটে নাগাদ শিরকা বুথে গিয়ে দেখা গেল, দীর্ঘ লাইন। এর মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি বেশি রয়েছে। ৬৮০ জন ভোটারের মধ্যে তখন অবধি ভোট দিয়েছেন ৩৭৫ জন। কালীপদ মাহাতো, ফনি কুম্ভকার, শঙ্কর কুম্ভকার বলেন, “আগে ভোট দিতে এলে ভয় লাগত। মনে হত এই বুঝি কিছু ঘটে গেল। এ বার আতঙ্ক ছাড়াই ভোট দিতে পেরে ভাল লাগছে।” মাও প্রভাবিত এলাকা বলে পরিচিত বোরো থানার মামড়ো প্রাথমিক স্কুলে বিকেল ৪টেতেও পুরুষ ও মহিলাদের লম্বা লাইন চোখে পড়ল।
বিক্ষিপ্ত কিছু ঝামেলা ছাড়া, জঙ্গলমহলে শান্তির এই ভোট অন্য কিছুর কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? অজানা এই উত্তরের জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। |