যুবভারতী ক্যাম্পাসে রাজ্য হকি সংস্থাকে দেওয়া চার একর জমি হঠাৎই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য ক্রীড়া দফতর। গত দু’বছর ধরে সেখানে অ্যাস্ট্রোটার্ফ বসানোর জন্য নিয়মিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বয়ং মদন মিত্র। ক্রীড়ামন্ত্রী নিজেই সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে এই নিয়ে সভা করেছেন বহু বার। প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। উল্টে সেই মাঠ, যেখানে বাংলার হকির পুনরুজ্জীবন ঘটার কথা, তা এখন বিভিন্ন ডেকরেটার্স সংস্থার গো ডাউন। সেখানে ডাঁই করা বাঁশ আর একাধিক ঝুপড়ি।
অ্যাস্ট্রোটার্ফ বসানোর ব্যাপারে দু’বছর ধরে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বৃহস্পতিবার ক্রীড়ামন্ত্রী বলে দিলেন, “যুবভারতীর ভিতর হকির জন্য কোনও জায়গা দেওয়া যাবে না। বাম সরকার কাকে কী জমি দিয়েছে, তা আমি মানতে যাব কেন?” সঙ্গে অবশ্য তাঁর প্রতিশ্রুতি, “হকির জন্য একটা নিজস্ব মাঠ দরকার, যেখানে অ্যাস্ট্রোটার্ফ বসানো যায়। আমি চেষ্টা করছি, কোথাও যদি একটা জায়গা দেওয়া যায়।”
যুবভারতীতে অ্যাস্ট্রোটার্ফ বসলে কী হত?
লস অ্যাঞ্জেলিস থেকে ফোনে বি এইচ এ-র গত ষোলো বছরের সচিব গুরবক্স সিংহ আফসোস করে বললেন, “আরে, তা হলে দেখতেন ক্রিকেটের নাইট রাইডার্সের মতো হকিতেও শাহরুখ খানের নেওয়া একটা কলকাতার দল খেলত হকি ইন্ডিয়া লিগে। হকি ইন্ডিয়ার লোকজন বারবার বলেছিল, কলকাতার টিম হলে শাহরুখ একটা টিম করতে চায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অ্যাস্ট্রোটাফর্র্ বসাতে পারলাম না। কেন যে সরকার জমিটা আটকে রেখে দিল, আজ পর্যন্ত তা বুঝতে পারলাম না।”
বাম সরকার ২০১০-এর ১ জানুয়ারি যুবভারতীর দু’নম্বর গেটের ভিতর চার একর জমি দশ বছরের জন্য লিজ হিসাবে দেয় রাজ্য হকি সংস্থাকে। অনুষ্ঠানিক ভাবে সেটি তুলে দেওয়া হয় ওই বছরই অক্টোবরের প্রথম দিন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত অলিম্পিয়ান লেসলি ক্লডিয়াস, অলিম্পিয়ান কেশব দত্ত, গুরবক্স সিংহ-সহ রাজ্য সংস্থার কর্তারা। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় ওই জমিতে থাকা ছোট ছোট ন’টি ঝুপড়ি এবং বাড়ি নিয়ে। মাঠ থেকে ডেকরেটর্সের জিনিসপত্র সরানো হলেও বাড়িগুলি ভেঙে দেওয়ার আগেই রাজ্যে পালাবদল ঘটে। এর পরই বি এইচ এ কর্তারা জমিটি পাওয়ার জন্য ক্রীড়ামন্ত্রীর দ্বারস্থ হন। চিঠি দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। ঠিক হয়, জমি পাওয়া গেলে সেটি উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে মুখ্যমন্ত্রীকে।
অ্যাস্ট্রোটার্ফ বসানোর ব্যাপারে একটি কমিটিও তৈরি হয়। তার চেয়ারম্যান হন মদনবাবু। কমিটিতে রাখা হয় কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারকে। ২০১১-র ১৬ ডিসেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সেই কমিটির সভা হয়। বি এইচ এ-র মিনিটস বুকে লেখা রয়েছে, ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং ক্রীড়ামন্ত্রী। সেখানে ঠিক হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই ঝুপড়ি ও বাড়িগুলি তুলে দিয়ে বি এইচ এ-র হাতে পরিষ্কার জমিটি তুলে দেওয়া হবে। ব্যাস, ওইটুকুই। সেই আশ্বাসের পর আর কোনও উদ্যোগ নেননি ক্রীড়ামন্ত্রী। বারবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও কোনও উত্তর পাননি বি এইচ এ কর্তারাও।
ক্রীড়ামন্ত্রী অবশ্য বৃহস্পতিবার রাতে বর্ধমান থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকে বলে দিলেন, “টেন্ডার করে জমি দেওয়াই হল আমাদের নীতি। আমার কাছে যুবভারতীর যে নকশা আছে, তাতে হকির জমি একটি হোটেলকে দেওয়া হয়েছে।” কিন্তু বি এইচ এ যে চুক্তির কাগজ দেখাচ্ছে সেই জায়গায় তো হোটেল নেই! ক্রীড়ামন্ত্রী বলেন, “এটা দেওয়া যাবে না। সুভাষ চক্রবর্তী কাকে কী জমি দিয়েছে, আমি মানতে যাব কেন?”
কিন্তু আপনিই তো অ্যাস্ট্রোটার্ফ কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ওই জমি পরিষ্কার করে তুলে দেওয়া হবে বি এইচ এ-র হাতে? এই প্রশ্ন শুনে ক্রীড়ামন্ত্রী বলেন, “ওরা ভালবেসে চেয়ারম্যান করেছিল। তা ছাড়া আমি এ রকম কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানি না। আর ২০১৭ যুব বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য মাঠ দু’বছর আগে নিয়ে নেবে। ওখানে হকি করা যাবে না। শুধু ফুটবল হবে।”
ক্রীড়ামন্ত্রীর এই ভোলবদলে অবশ্য প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ বি এইচ এ কর্তারা। অলিম্পিয়ানরাও। অলিম্পিয়ান কেশব দত্ত বললেন, “জীবদ্দশায় আর অ্যাস্ট্রোটার্ফ দেখে যেতে পারব কী না জানি না। কিন্তু ক্রীড়ামন্ত্রীই তো একবার একটা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আপনাদের অ্যাস্ট্রোটার্ফ কিছু দিনের মধ্যেই সল্টলেকে হয়ে যাবে।” আর এক অলিম্পিয়ান বীরবাহাদুর ছেত্রী বললেন, “অ্যাস্ট্রোটার্ফ খুবই দরকার। আমরা তো কোনও রাজনীতি করি না। শুধু চাই হকির একটা মাঠ হোক। তা হলে খেলাটার পুররুজ্জীবন ঘটবে।”
কিন্তু সেই স্বপ্ন কবে বাস্তব হবে, তা কেউ জানেন না। |