একদিকে ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়ছে মাওবাদী তৎপরতা। এমনকী জেলার অভ্যন্তরেও বহুদিন ধরেই মাওবাদী গতিবিধি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের চোখে পড়ছে। তার উপর মাত্র কয়েক দিন আগেই নিকটবর্তী দুমকাতে মাওবাদী হামলায় নিহত হলেন পাকুড়ের পুলিশ সুপার-সহ সাত পুলিশকর্মী। এই পরিস্থিতিতে জেলায় বেশ কয়েকটি নতুন থানা গড়ে তোলার পুরনো দাবিটি ফের উঠতে শুরু করেছে। শুধু স্থানীয় বাসিন্দা বা রাজনৈতিক দল নয়, এই দাবি উঠছে জেলার পুলিশ-প্রশাসনের ভেতর থেকেও।
মাওবাদী তৎপরতাকে মাথায় রেখে জেলার পুলিশ-প্রশাসন বহু দিন ধরে এখানে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার দাবি তুলছিলেন। সম্প্রতি সেই দাবি মেনে জেলায় ২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবে পৃথক থানাগুলির দাবি কবে মানা হবে, সে বিষয়ে কেউ কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি। জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলেন, “জেলায় কোথায় কোথায় নতুন থানা দরকার, তা পুলিশ সুপার খতিয়ে দেখেন। এ ক্ষেত্রে যা বলার তিনিই বলবেন।”
জেলার মোট ১৯টি ব্লকে থানা আছে ১৮টি। কোনও থানা নেই সিউড়ি ২, ময়ূরেশ্বর ১, নলহাটি ২ ও মুরারই ২ ব্লকগুলিতে। সেই ১৯৮৭-৮৮ সালে খয়রাশোল থানা ভেঙে কাঁকরতলা, সিউড়ি থানা ভেঙে সদাইপুর, বোলপুর থানা ভেঙে মাড়গ্রাম থানা গঠিত হয়। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে জেলায় ৩৫০ জন সশস্ত্র পুলিশ, ৫০০ জন পুলিশ কর্মী এবং ২০০ জন হোমগার্ড আছেন। এই স্বল্প সংখ্যক পুলিশকর্মী দিয়ে অপরাধ ঠেকানোর ক্ষেত্রে সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন জেলা পুলিশের কর্তাদের একটা বড় অংশই। জেলার একটি থানার ওসির ক্ষোভ, “উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় নতুন নতুন থানা গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ বীরভূমে দীর্ঘদিন ধরে কোনও নতুন থানা তৈরি হয়নি।”
জেলা পুলিশের আধিকারিকদের একাংশের মত, রামপুরহাট মহকুমার আটটি ব্লকের বেশ কয়েকটি জায়গায় পৃথক থানা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। অথচ গত তারপরে ২৫ বছরে জেলায় নতুন কোনও থানা গড়ে তোলা হয়নি। এমনকী জেলায় এখন এমন ব্লকও (নলহাটি ১ ও ২ ব্লক) আছে, যেখানে এতদিনেও পৃথক কোনও পুলিশ ফাঁড়ি নেই। আবার আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পৃথক থানা থাকা জরুরি হলেও মল্লারপুর, তারাপীঠ, কীর্ণাহার, পাইকর এলাকাগুলি রয়েছে সাব-ইন্সপেক্টর পরিচালিত ফাঁড়ি। নলহাটি থানার অধীন লোহাপুরে মাত্র ৬-৭ জনকে নিয়ে একটি সশস্ত্র পুলিশ ক্যাম্প আছে। চালু হয়েছিল সেই ১৯৭৭-৭৮ সালে। তখন লোহাপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বড় ধরনের ডাকাতি হয়েছিল। ডাকাত দলের আক্রমণে এক স্বাস্থ্যকর্মী খুনও হয়েছিলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসকের নিজস্ব বন্দুকটিও ডাকাতেরা লুঠ করে। ওই ঘটনার জেরে চালু হওয়া ক্যাম্পটি এতদিনেও থানাতে রূপান্তরিত করা যায়নি। সেই ক্যাম্পের আবার কোনও নিজস্ব ভবন নেই। পুলিশকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা আছে ব্লক হাসপাতালের একটি ঘরে!
স্থানীয় তৃণমূল নেতা গিয়াসউদ্দিন বলেন, “নলহাটি থানা থেকে মুর্শিদাবাদ সীমান্তের দূরত্ব ২০ কিমি। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ৬০ নম্বর রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম জাতীয় সড়কের সঙ্গে সীমান্তবর্তী মোরগ্রামের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের যোগাযোগ আছে। লোহাপুরে থানা হলে এই বিস্তীর্ণ এলাকার আইনশঙ্খলার পরিস্থিতি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।” জেলা পরিষদের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, কংগ্রেসের অতুলচন্দ্র দাসের দাবি, “বেশ কয়েক বার জেলার প্রশাসনিক স্তরে বৈঠকে লোহাপুরে পৃথক থানা গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু এখনও সেই দাবি পূরণ হয়নি।” এলাকার সিপিএম নেতা আব্দুস সালাম বলেন, “লোহাপুরে থানা তৈরি হলে মানুষের হয়রানি কমবে। কারণ শীতলগ্রাম পঞ্চায়েতের টিঠিডাঙা, বারুনিঘাটা, কামালপুর, প্রসাদপুর, সাবেহ নগর, হামিদপুর এই সমস্ত এলাকাগুলি নলহাটি থানা থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে। ওই সমস্ত এলাকা থেকে থানায় অভিযোগ জানাতে আসতে বাসিন্দারা সমস্যায় পড়েন। হয়রানির ভয়ে অনেকেই অভিযোগ না জানিয়ে সালিশি করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেন।”
এ দিকে নলহাটি, মুরারই, ময়ূরেশ্বর এই তিন থানারই বিস্তীর্ণ এলাকায় পৌঁছতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রেল গেট। এই তিনটি থানারই মধ্যে পড়ে সাহেবগঞ্জ-বর্ধমান লুপ লাইনের রেলগেট। যার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছতে পারে না বলে অভিযোগ। এ ছাড়াও ওই তিনটি থানার অধীনে তিনটি ব্লক প্রশাসনিক ভবনও পড়ে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “ব্লক প্রশাসনিক কার্যালয়ে তো অনেক সময় আইনশৃঙ্খলরা অবনিতি ঘটে। সেক্ষেত্রে পাইকরে অবস্থিত ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক প্রশাসনিক কার্যালয়, মল্লারপুরে অবস্থিত নলহাটি ২ ব্লক প্রশাসনিক কার্যালয়গুলির জন্য পাইকরে, মল্লারপুরে ও লোহাপুরে অবশ্যই পৃথক থানা তৈরি করার প্রয়োজন আছে।” সিউড়ি ২ ব্লকের প্রশাসনিক ভবন লাগোয়া এলাকায় পৃথক থানা গড়ে তোলার দাবিতে সম্মতি জানিয়েছেন বিডিও সারওয়াৎ আব্বাসও।
পৃথক থানার প্রয়োজন আছে তারাপীঠেও। যতদিন যাচ্ছে তারাপীঠকে কেন্দ্র করে অপরাধীরা একটি বিশেষ ‘জোন’ তৈরি করছে বলে পুলিশের দাবি। এ ছাড়া তারাপীঠে আগত পূণ্যার্থীদের ভিড় সামলানোর দিকটিও আছে। কিন্তু ভিড় বা অপরাধ নিয়েন্ত্রণে তারাপীঠে বর্তমানে থাকা পুলিশ ফাঁড়িই যথেষ্ট নয় বলে পুলিশ কর্তাদের দাবি। তারামাতা সেবাইত সমিতির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায় বলেন, “বুদ্ধগয়ায় বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে তারাপীঠের মতো জনবহুল তীর্থক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা নিয়ে প্রশাসনের ভাবা উচিত। সব মিলিয়ে তারাপীঠে একটি পৃথক থানা দরকার।”
জেলার পুলিশ সুপার অবশ্য বলছেন, “ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মল্লারপুরে একটি পৃথক থানা গড়া হবে। তা ছাড়া লোহাপুর, পাইকরের মতো কয়েকটি জায়গাতে পৃথক থানা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।” |