|
|
|
|
ভোটের মাঠে দাপট বালি মাফিয়াদের |
নীলোৎপল রায়চৌধুরী • রানিগঞ্জ |
পরিবর্তনের জমানায় এ-ও যেন এক রকম পরিবর্তন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রচার থেকে শুরু করে ‘ভোট করানো’, সব কিছুরই রাশ কয়লা মাফিয়াদের হাতেগত বার পর্যন্ত আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে এমনই অভিযোগই তুলে এসেছে বিরোধী দলগুলি। কয়লা মাফিয়াদের সঙ্গে তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের অশুভ আঁতাতের দাবিতে সরব হয়েছে তারা। আবার নির্বাচন এসেছে। ফের উঠছে ভোটের কাজে মাফিয়াদের ব্যবহারের নালিশ। এ বার আঙুল বর্তমান শাসকদল তৃণমূলের দিকে। পাল্টেছে কাজে নামা মাফিয়াদের ধরনও। কয়লা নয়, এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বালি মাফিয়ারাই, অভিযোগ শিল্পাঞ্চলবাসীর। তবে তৃণমূল একা নয়, কংগ্রেস এবং সিপিএম-ও ভোটের কাজে মাফিয়াদের ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ। যদিও রাজনৈতিক দলগুলি তা মানতে নারাজ। |
|
কেটে ফেলে রাখা হয়েছে বালি। জামুড়িয়ার নিঘায় তোলা নিজস্ব চিত্র। |
ভোটে নানাবিধ কাজ মাফিয়াদের। কোনও দলের জনসভায় ভিড় বাড়াতে লোক পাঠানো, তাদের সারা দিনের রাহা খরচ দেওয়া থেকে শুরু করে প্রচারে সাহায্য, ঝামেলা কম নয়। নিন্দুকেরা বলেন, ভোটের দিনের জন্য আবার আলাদা করে অর্থ জোগাতেও ভরসা মাফিয়াদের। এখানেই শেষ নয়, সঙ্গে রয়েছে বোমা বাঁধার মশলার খরচ থেকে শুরু করে প্রয়োজন মতো ধমক-চমক দিতে লোক পাঠানোর কাজও। রানিগঞ্জের বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, এ বার তিরাট, জেমারি, চেলোদ ও রতিবাটি পঞ্চায়েতেই বালি মাফিয়াদের রমরমা। সেখানে সক্রিয় জলধর ও কাজল নামে দু’জন। এগরায় আবার রয়েছেন সজল নামে এক কয়লা মাফিয়াও। শেষ পঞ্চায়েত ভোটে তাকে সিপিএমকে সাহায্য করতে দেখা গিয়েছিল, দাবি কয়েক জন এলাকাবাসীর।
এলাকাবাসী ও রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের দাবি, পুলিশ কমিশনারেট হওয়ার পরে কিছু ধরপাকড় শুরু হওয়ায় কয়লা পাচার সামান্য কমেছে। তার জায়গায় ফুলেফেঁপে উঠছে বালি, লোহা ও মাটি পাচার। এ বার ভোটেও তাই ওই সবের সঙ্গে যুক্ত লোকজনই ‘গুরুত্ব’ পাচ্ছেন।
জামুড়িয়ার নিঘায় পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের সামনে গেলে দেখা যায়, প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মজুত রয়েছে বালি। জেকে নগরে একটি বেসরকারি সংস্থার জমিতেও সেই একই চিত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, তিরাট সংলগ্ন ডামরা ঘাট, ম্যাগাজিন ঘাট ও তিরাটের মা কালী ঘাট থেকে বালি কাটা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করছে জলধর নামে এক ব্যক্তি। তিরাটেরই কল্যাণেশ্বরী ঘাট থেকে কাজলের তত্ত্বাবধানে বালি কাটা হচ্ছে। এলাকাবাসীর একাংশের দাবি, এই বালিই জমা হচ্ছে নিঘার ওই পরিত্যক্ত জমিতে।
জলধর অবশ্য দাবি করেন, এক ঠিকা সংস্থার হয়ে তিনটি কোলিয়ারির ভূগর্ভে বালি সরবরাহ করেন তিনি। এ বার ভোটে চারটি পঞ্চায়েত এলাকায় শাসকদলের বড় ভরসা তিনিই, এমন অভিযোগ সম্পর্কে জলধরের বক্তব্য, “সব মিথ্যা প্রচার। চক্রান্ত করে কংগ্রেস, তৃণমূল এবং আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে।” কংগ্রেসের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) কমিটির সম্পাদক দেবাশিস রায়চৌধুরীর যদিও বক্তব্য, “তৃণমূল যে ভাবে ওদের নিয়ন্ত্রণ করছে, আমাদের সেখানে নিয়ন্ত্রণের কোনও জায়গাই নেই।” শুধু এখানে নয়, এগরা পঞ্চায়েত এলাকাতেও পেপারমিল ঘাট থেকে বালি কেটে পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ। তাতেও আঙুল তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কিছু যুবকের দিকে।
২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে রতিবাটিতে মুন্না, শিবপ্রসাদ, জেমারিতে কয়লা মাফিয়া বিশ্বনাথের হয়ে অশোক, তিরাটে কল্যাণ তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের হয়ে ময়দানে নেমেছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ। এ বার অবশ্য ভোট-যুদ্ধে তাদের দেখা নেই বলে এলাকা সূত্রে খবর। রানিগঞ্জ জোনাল কমিটির সম্পাদক রুনু দত্ত অবশ্য বলছেন, “আমাদের নামে কুৎসা করা হলেও মাফিয়াদের নিয়ে কেউ আমাদের ঘুরতে দেখেনি।” তার পরেই তাঁর দাবি, “এ বার পঞ্চায়েত ভোটে বালি মাফিয়ারা সক্রিয়। তাদের সঙ্গে কয়লা, লোহা মাফিয়ারাও শাসকদলের নির্বাচনী জনসভায় প্রকাশ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছেন, তা তো সবাই দেখতে পাচ্ছেন।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বালি মাফিয়ারা রীতিমতো আটঘাট বেঁধে কাজ করে। প্রতিটি বালি ঘাটে এক জন করে প্রতিনিধি দাঁড় করিয়ে, তার নামে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর থেকে বালি কাটার জন্য মাসিক রাজস্ব দেওয়া হয়। কিন্তু যে পরিমাণ রাজস্ব জমা দেওয়া হয়, তার দশ-কুড়ি গুণ বালি কেটে পাচার করা হয়। তবে আসানসোল পুরসভার চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র তিওয়ারির দাবি, “রাজস্ব আদায় অনেকটা বেড়েছে। আমাদের সঙ্গে বালি মাফিয়াদের কোনও যোগ নেই।”
অবৈধ ভাবে বালি কাটার জেরে ইতিমধ্যে এডিডিএ-র গড়া তিরাটের একটি রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অভিযোগ, এর জেরে জলপ্রকল্প দূষিত হচ্ছে। যন্ত্রের সাহায্যে অবৈজ্ঞানিক ও বেআইনি ভাবে বালি কাটা হচ্ছে। সব দফতরকে জানিয়েও প্রতিকার মেলেনি। দফতরের এক আধিকারিক জানান, দামোদরে বালির গভীরতা কমছে। পাম্পগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমছে। পর্যাপ্ত বালি না মেলায় শোধন করে পরিস্রুত জল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে নদে বালির উচ্চতা ১০ মিটার থেকে কমে ৬ মিটার হয়ে গিয়েছে, দাবি ওই আধিকারিকের। জেমারি পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান নিমাই ঘোষের অভিযোগ, “আমার এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বালি মজুত করে রাখা হয়েছে, যার কোনও অনুমতি পঞ্চায়েত দফতর থেকে নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট সব দফতরে জানালেও লাভ হয়নি।”
পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ বলেন, “বালি কাটার বিষয়টি ভূমি রাজস্ব দফতরের অধীন। তারা অভিযোগ করলেই আমরা ব্যবস্থা নিই। মাস ছয়েক আগে হিরাপুরের ঘাট নিয়ে অভিযোগ হয়েছিল। আমরা অভিযান চালিয়ে বন্ধ করেছি। তার পরে আর কোনও অভিযোগ পাইনি। পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস বলেন, “বেআইনি ভাবে বালি কাটা ও পাচারের অভিযোগ ভূমি রাজস্ব দফতরকে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিতে বলব।” |
|
|
|
|
|