কাজ থেকে ছুটি পেলেই ছুটে যেতেন কখনও অজিন্ঠা, বুদ্ধগয়া বা বদ্রীনাথে। আবার কখনও মায়াবতী বা মুসৌরিতে। ঘরের কাছের শৈলশহর দার্জিলিঙেও একবার নয়, একাধিকবার এসেছেন। সঙ্গে থাকতেন জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু। তিনি, সিস্টার নিবেদিতা।
দার্জিলিং শহরে তাঁদের অবসরের আশ্রয় হয়ে উঠত ডাঃ নীলরতন সরকারের ‘গ্লেন ইডেন’ কিংবা ‘অ্যাসেলিন ভিলা’ অথবা অবলা বসুর ভগ্নিপতি দ্বারকানাথ রায়ের ‘রায় ভিলা’।
লেবং কার্ট রো ধরে এগোলে রক আইল্যান্ড থেকে দেখা যায় ওক, পাইনের ফাঁকে পাহাড়ের গায়ে হেলান দেওয়া তিন তলা বিশাল বাড়িটি। চারপাশ ছিল শান্ত আর নির্জন। দৃষ্টিসীমায় বাধা পড়ে থাকে উত্তুঙ্গ হিমালয়। জনবিরল সেই পাহাড়ি অঞ্চলে বাতাসের শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ কানে আসত না তখন।
সময়টা ১৯১১। অক্টোবরের প্রথমে সে বারে জগদীশচন্দ্রের আগ্রহেই নিবেদিতার দার্জিলিং যাত্রা। আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। নিবেদিতার ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় জগদীশচন্দ্র বেছে নিলেন ঘরের কাছের পাহাড়ি শহরটিকে। তাতে সায় ছিল নিবেদিতারও। |
আগেই বেরিয়ে পড়লেন বসু দম্পতি। দার্জিলিঙে গিয়ে তোড়জোড় শুরু করলেন সিকিম সফরের। নিবেদিতা ক’দিন পরে দার্জিলিঙে পৌঁছে যোগ দিলেন তাঁদের সঙ্গে। সিকিম সফরের কথা শুনে তাঁর মনটা নড়েচড়ে উঠল, ‘ওখানে একটি মঠ আছে, দেখব।’ গন্তব্য তাঁদের দার্জিলিং থেকে তিব্বতের পথ ধরে সান্দাক ফু। বাহন বলতে শুধুই ঘোড়া। সেখানে দ্রষ্টব্য বারো হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটি বৌদ্ধমঠ। বিছানাপত্র বেঁধে খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে যাত্রার প্রস্তুতি যখন সম্পূর্ণ, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন নিবেদিতা। যাত্রা মুলতুবি রইল। জ্বর আর রক্ত আমাশয়ে তাঁর অবস্থা তখন সঙ্গীন। ডাঃ নীলরতন সরকারের কাছে পাঠানো হল তাঁকে। তিনি চিকিৎসা শুরু করলেন বটে কিন্তু বুঝলেন নিরাময় সম্ভব নয়।
নিবেদিতার রোগশয্যার পাশে সর্বক্ষণ বসে থাকতেন বসুজায়া। সেবা-শুশ্রূষার ভারটি তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। জগদীশচন্দ্র পড়ে শোনাতেন তাঁর প্রিয় বিষয়ের কোনও গ্রন্থ। শারীরিক যন্ত্রণার কথা মুখ ফুটে তিনি বলতে চান না। সকলে তাঁর হাসি মুখটাই দেখতেন।
আশ্বাস দিতেন অবলা বসু, এ রোগ প্রাণঘাতী নয়। শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন শেষের দিন সমাগত। আশ্বাস দিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না। সেটা অবশ্যম্ভাবী। শান্ত চিত্তে বললেন, ‘লেট, দেয়ার বি নো হাইডিং, অ্যান্ড ডোন্ট ট্রাই টু প্রোলং।’ অসুস্থতা সত্ত্বেও তাঁর চিন্তাধারা সজীব। ভাবনার স্রোত থেমে যায়নি। ৭ অক্টোবর উকিল ডেকে আনা হল। স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের যে সংকল্প করেছিলেন, শেষ প্রহরেও তা অটুট। দানপত্র তৈরি করলেন। সঞ্চিত সমস্ত অর্থ এমনকী ভবিষ্যতে তাঁর বইয়ের বিক্রিত অর্থ বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য বেলুড় মঠের ট্রাস্টিদের হাতে অর্পণ করলেন। তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রম অবনতি ঘটতে লাগল। শেষ বেলায় নিবেদিতারই অনূদিত বৌদ্ধ প্রার্থনাবাণী পাঠ করে শোনালেন অবলা। আর নিবেদিতার ক্ষীণ কণ্ঠে সেই দিব্যবাণীঅসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়......। বললেন, ‘তরণী ডুবছে, আমি কিন্তু সূর্যোদয় দেখব।’
১৩ অক্টোবর, শুক্রবার। খাবার খেলেন না। ওষুধও নয়। খুলে দিলেন অক্সিজেনের নলটিও। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। শেষবার তাঁকে দেখবার জন্য ভিড় জমে গিয়েছিল রায় ভিলার সামনে। বেলা ২টোয় রায় ভিলা থেকে যে শেষযাত্রা বের হল, তাতে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যক্ষ শশীভূষণ দত্ত, ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার, নিশিকান্ত সেন বাহাদুর, জগদীশচন্দ্রের ছাত্র বশীশ্বর, রাজেন্দ্রলাল দে, পি এডগারের মতো বিশিষ্টরা।
নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ‘গ্লেন ইডেন’, নেই ‘অ্যাসেলিন ভিলা’ও। নিবেদিতার স্মৃতি নিয়ে কিন্তু আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘রায় ভিলা’। বাঙালির বিষণ্ণ স্মারক। |