|
|
|
|
রাজ্য রাজি, টাটাদের জবাব জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট |
ক্ষতিপূরণে খোলার চেষ্টা সিঙ্গুর-জট |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে সিঙ্গুরের জমি তারা ছেড়ে দেবে কি না, আজ টাটাদের কাছে তা জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে তাদের প্রশ্ন, যে কারণে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সে শিল্পই যদি না হয়, তা হলে ওই জমি কেন আসল মালিকের কাছে ফেরত যাবে না? টাটাকে পরবর্তী শুনানির দিন অর্থাৎ ১৩ অগস্ট ক্ষতিপূরণ নিয়ে জবাব জানাতে বলা হয়েছে। হলফনামা দিতে বলা হয়েছে রাজ্যকেও। এর ফলে ক্ষীণ হলেও সিঙ্গুরে জমি-জটিলতা মেটার আশা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। কিন্তু অন্য পক্ষ বলছে, বাস্তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ সিঙ্গুর আইন বৈধ না অবৈধ, সেই প্রশ্নেরই এখনও ফয়সালা হয়নি। সিঙ্গুর আইন বৈধ বলে স্বীকৃতি পেলে তবেই তো ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন উঠবে এবং তার কত অঙ্ক নিয়ে হিসেবনিকেশ হবে।
সিঙ্গুরে ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ এই প্রথম উঠল না। এর আগে হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়েও ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয়েছিল। রাজ্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, টাটাদের যেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সেই মতো হুগলির জেলা জজকে দায়িত্বও দেওয়া হয়। কিন্তু সিঙ্গল বেঞ্চে হারের পরে টাটারা ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে। সেখানে রায় রাজ্যের বিরুদ্ধে যায়। সিঙ্গুর আইনকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে ডিভিশন বেঞ্চ। সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে রাজ্য।
সেই মামলাতেই এ বারে ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ তুলল শীর্ষ আদালতের বিচারপতি এইচ এল দাত্তু এবং দীপক মিশ্রর ডিভিশন বেঞ্চ। |
 |
রাজ্য সরকার এই বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে বলেছেন, “সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যে আমরা সকলে খুব খুশি। খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। আমরাও তো এটাই চেয়েছিলাম। ২০০৬ সাল থেকে চলছে। আমি নিজে ২৬ দিন অনশন করেছিলাম।” মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ সারা বিশ্বের কৃষিজীবী মানুষের আন্দোলনকে উৎসাহিত করবে। এটা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের নৈতিক জয়।
রাজ্য সরকারের তরফে এ-ও দাবি করা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের এই পদক্ষেপের পরে টাটা মোটরসের সঙ্গে সিঙ্গুরের জমি নিয়ে বিবাদ মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ, ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেলে টাটারও জমি ছেড়ে দিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে কৃষকদেরও জমি ফিরিয়ে দিতে কোনও অসুবিধা থাকবে না। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সিঙ্গুর-বিবাদ মেটানোর রাজনৈতিক প্রয়োজনটাই এখন বেশি। তাই পঞ্চায়েত ভোট শুরুর ঠিক আগের দিন সুপ্রিম কোর্টের এই অবস্থান তৃণমূল নেতৃত্বকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে।
টাটাদের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, যে সিঙ্গুর আইনের বলে টাটাদের লিজ দেওয়া জমি মমতার সরকার ফের দখল করেছিল, তা কলকাতা হাইকোর্ট অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট তা নিয়ে এখনও কোনও রায় দেয়নি। ওই আইন বৈধ বলে স্বীকৃতি পেলে তবেই ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসছে। তার পরে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কত হবে, সেই প্রশ্ন আসবে।
আর এখানেই প্রবল মতভেদের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে প্রশাসনিক মহলের একাংশ।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা প্রথম সিঙ্গুর আইন তৈরির কথাই ঘোষণা করেছিলেন। সেই মতো আইন হয়। জমি পুনর্দখল হয়। তার পরে ওই আইনের বিরুদ্ধে সে বছরেরই ২২ জুন হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে যায় টাটারা। তার পর থেকে ঠিক দু’বছর কেটেছে। এখনও মামলার নিষ্পত্তি নিয়ে কোনও আশার আলো নেই। এ দিন সেই মামলারই শুনানির সময়ে সুপ্রিম কোর্ট টাটাদের কাছে জানতে চায়, ন্যানোর কারখানাই যখন গুজরাতের সানন্দে চলে গিয়েছে, তখন সিঙ্গুরের জমি রেখে দিয়ে টাটারা কী করতে চায়? উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে টাটারা কেন জমি ছেড়ে দেবে না? যে কারণে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেই শিল্পই যদি না হয়, তা হলে কেন জমি আসল মালিকের কাছে ফেরত যাবে না? বিচারপতিদের বক্তব্য, “সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল। এখন আর সেই উদ্দেশ্য নেই। টাটারা আর বলতে পারে না, এখনও ওই জমিতে তাদের আগ্রহ রয়েছে। এখন এই জমি কৃষকদেরই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।” এর পরেই তাঁদের মন্তব্য, “জমি নেওয়ার সময় টাটারা যে অর্থ
দিয়েছিল, আদালত রাজ্যকে তা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে। ন্যায়-বিচারের স্বার্থে সেটাই উচিত কাজ হবে।” |
সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল। এখন আর সেই উদ্দেশ্য নেই। টাটারা আর বলতে পারে না যে, এখনও ওই জমিতে তাদের আগ্রহ রয়েছে। এখন এই জমি কৃষকদেরই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। জমি নেওয়ার সময় টাটারা যে অর্থ দিয়েছিল, আদালত রাজ্যকে তা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে। ন্যায়-বিচারের স্বার্থে সেটাই উচিত কাজ হবে।
সুপ্রিম কোর্ট |
সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যে আমরা সকলে খুব খুশি। খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। আমরাও তো এটাই চেয়েছিলাম। কৃষিটাও একটা শিল্প। কৃষি এবং শিল্প দু’টিকেই আমরা ভালবাসি। এটা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের নৈতিক জয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছে, সিঙ্গুরের জমি নিয়ে আমাদের বিকল্প আর কী করার আছে। আমরা সব দিক খতিয়ে দেখে শীর্ষ আদালতকে জানাব। আদালত বলেছে, আমরা জমি ব্যবহার করতে না পারলে এবং ফেরত দিলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আমরা এই বিষয়টিও অবশ্যই খতিয়ে দেখব।
টাটা মোটরস |
|
২০১১
১৪ জুন: সিঙ্গুর জমি আইন পাশ
২১ জুন: সিঙ্গুরের জমি দখল রাজ্যের
২২ জুন: আইন অবৈধ আখ্যা দিয়ে হাইকোর্টে টাটা
২৮ সেপ্টেম্বর: সিঙ্গল বেঞ্চের রায়: আইন বৈধ। ক্ষতিপূরণ দিক রাজ্য
১ নভেম্বর: ডিভিশন বেঞ্চে টাটা |
২০১২
২২ জুন: ডিভিশন বেঞ্চের রায় আইন অবৈধ ও অসাংবিধানিক
২৪ অগস্ট: সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য, স্থগিত ডিভিশন বেঞ্চের রায় |
২০১৩
১০ জুলাই: সুপ্রিম কোর্ট ক্ষতিপূরণ নিয়ে জমি ফেরত দেবে কি না, টাটাকে প্রশ্ন |
|
রাজ্যের তরফে আদালতে হাজির ছিলেন আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পরে বলেন, “মা-মাটি-মানুষের সরকার তো বারবারই বলেছে, টাটারা চলে গেলে কেন জমি ফেরত দেব না? আজ সুপ্রিম কোর্ট সেই কথাই অন্য ভাষায় বলেছে।” টাটার অন্যতম আইনজীবী সিদ্ধার্থ মিত্র বলেন, “আদালত জানতে চেয়েছে, কারখানা যখন হয়নি, তখন এই নিয়ে আপনারা কী করতে চান? এই প্রশ্নের উত্তরে আজ আমরা কিছু বলিনি। বিচারপতিরাও বলেছেন, তাঁরা আজই এর উত্তর চাইছেন না। এখনও সিঙ্গুর আইন বৈধ না অবৈধ, তা খতিয়েই দেখেনি আদালত।”
এই মামলার পাশাপাশি সিঙ্গুর নিয়ে আরও একটি মামলা চলছে সর্বোচ্চ আদালতে। বাম-আমলে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ বৈধ ছিল কি না, তা নিয়েই মামলা করেছিল এপিডিআর। সেটিকে রাজ্যের আপিল মামলার সঙ্গে জুড়ে নেওয়া হয়েছে। আজ এপিডিআর-এর আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, “আসল জমি অধিগ্রহণ আইনসঙ্গত ছিল কি না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও পরে তা বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই জমি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তা হলে কৃষকরা কেন তা ফেরত পাবে না?” টাটা মোটরসের আইনজীবী যুক্তি দেন, জমি ফেরত দেওয়া যায় কি না, সেটাই প্রশ্ন। কারণ যে আইনে জমি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেই সিঙ্গুর আইন সাংবিধানিক না অসাংবিধানিক, বৈধ না অবৈধ, সেটা নিয়েই মামলা হচ্ছে।
এই সময় বিচারপতি দাত্তু বলেন, জমি ফেরত দেওয়া যায় কি না, আইন বৈধ না অবৈধ, প্রাথমিক স্তরে জমি অধিগ্রহণ আইনসঙ্গত ছিল কি না, তা পরে দেখা হবে। এটি ‘অ্যাকাডেমিক’ বিষয়। কিন্তু টাটা মোটরস জবাব দিক, তারা কী ভাবে জমি রেখে দিতে পারে। টাটার তরফে বলা হয়, তারা ৯০ বছরের জন্য জমি লিজে পেয়েছেন। তখন বিচারপতিরা জানতে চান, সিঙ্গুরের প্রকল্প গুজরাতে সরে গিয়েছে। তা হলে প্রয়োজনে সুদ-সহ ক্ষতিপূরণ নিয়ে টাটারা কেন জমি ছাড়বে না? যেখানে কোনও শিল্পও হচ্ছে না, জমি ধরে রেখে সংস্থার কোনও লাভও হচ্ছে না, তা হলে জমি কেন আসল মালিকের কাছে ফেরত যাবে না?
সুপ্রিম কোর্টের তরফে রাজ্য সরকারের কাছেও জানতে চাওয়া হয়, তারা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি কি না? কল্যাণ জানান, ক্ষতিপূরণ যে দেওয়া হবে, তা রাজ্যের ঘোষিত অবস্থান। প্রয়োজনে এ বিষয়ে হলফনামা দিতেও রাজ্য সরকার তৈরি।
এর পরে টাটার আইনজীবীদের সুপ্রিম কোর্ট বলে, তাঁরা যেন তাঁদের মক্কেলের কাছে জেনে আসেন, টাটা মোটরস কী চায়? প্রথমে ঠিক হয়, দু’সপ্তাহ পরে টাটা মোটরসকে এর উত্তর জানাতে হবে। পরে সব পক্ষের আলোচনার পরে ঠিক হয়, ১৩ অগস্ট পরবর্তী শুনানি হবে। টাটার জবাব পাওয়ার পরেই সিঙ্গুর আইন বৈধ না অবৈধ, বাম-আমলের জমি অধিগ্রহণ আইনসঙ্গত ছিল কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে শীর্ষ আদালত। টাটা সূত্রের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক জমিই বিভিন্ন শিল্পসংস্থাকে দেওয়া হয়েছে, যেগুলি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে সিঙ্গুরের জমিতে যথেষ্ট কাজ হয়েছিল। কাজেই লিজ বাতিল হওয়ার শর্তও খাটছে না। আলাদা করে কেন সিঙ্গুরের জমিই বেছে নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নও তোলা হবে আদালতে।
|
পুরনো খবর: সিঙ্গুর মামলা গৃহীত সুপ্রিম কোর্টে |
|
|
 |
|
|