প্রবন্ধ ২...
যেখানে প্রাণ মহুয়া ফুলের মতো ঝরে
হাতের তালুর মতো চিনি, এমন দাবি করব না। কে-ই বা নিজের হাতের তালু চেনে? কথাটার মানেই বা কী? কিন্তু এই যে এলাকা, দুমকার কাঠিকুণ্ড, গোপীকান্দর, রামগড়, পাকুড়ের আমড়াপাড়া, এখানকার পাহাড়, জঙ্গল, পাকদণ্ডী পথ, ছোট ঝরনা, ফাঁকে ফাঁকে লোকবসত এবং এখানকার লোকসমুদয়, প্রধানত সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া, এদের বেশ চিনি। কাঠিকুণ্ডের কাছে যে জায়গায় উগ্রবাদী হানায় পাকুড়ের এস পি-সহ একদল পুলিশের প্রাণ গেল, তার কাছেই আছে একটা ঝরনা। কত কত দগ্ধ অপরাহ্ণে গ্রাম থেকে ফেরার পথে সেখানে দু’দণ্ড বসেছি কখনও বা স্নান করে নেওয়ার লোভও সামলাতে পারিনি। অনেক মধ্যরাত্রে এই পথ দিয়ে গ্রাম থেকে ফিরেছি। বহু বহু রাত কেটেছে টেসাফুলি, ঝুঁজো, কোল্হা, কোলিয়ো, মহুলডাবর, শিলিঙ্গি, কুণ্ডাপাহাড়ি, খাটাঙ্গা ও আরও নানা গ্রামে। বেশি তো নয়, এই এক দশকের কিছু আগে। বছর পাঁচেক আগেও কুণ্ডাপাহাড়িতে থেকে এসেছি। এমন নিরাপদ জায়গা বিরল। এমন নির্ভয়ে বিচরণের একমাত্র তুলনীয় বসত আমার নিজের গ্রাম, এখান থেকে যা ৩০০ মাইল দূরে। মনে পড়ে, এক বার রাতে ফিরতে গিয়ে মোটরসাইকেল খারাপ হয়। যন্ত্রটাকে রাস্তায় ফেলে রেখে মাইল পাঁচেক দূরের গ্রামে ফিরেছিলাম, অরূপ রাত্রির রূপবতী অরণ্যকে দেখতে দেখতে।
এখন আর যেতে পারি না, রাজনৈতিক পরিস্থিতিগত অনুমোদন নেই। বিস্তীর্ণ পাহাড়ে-অরণ্যে কথিত মাওবাদীদের সশস্ত্র অধিকার। অন্যদের তো দূর, স্থানীয় লোকেদেরও গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত। ২০১১ নভেম্বরে সর্বমান্য জনসেবিকা সিস্টার ওয়ালসা জন-এর হত্যার পর আতঙ্কের জমাট কুয়াশা। তাঁর হত্যাকারী কে, তার কোনও নিশ্চিত কিনারা হয়নি মাওবাদী, না কি কয়লাখনি কোম্পানি, না কি উভয়ে, না কি অন্য কেউ, তা নিয়ে ধন্দ আছে। কিন্তু এ অঞ্চলে মাওবাদীদের অনুপ্রবেশ বিষয়ে সন্দেহ নেই, তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে যে নাশকতার যোগ আছে, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি নিঃসন্দেহে যেটা বলা যায়, তা হল এই যে, এখানে মাওবাদীদের আগমন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এলাকায় গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে কয়লাখনি খোঁড়ার কার্যকলাপ, এ দুটো ঘটনা এক সঙ্গে ঘটেছে, এবং এটা কাকতালীয় নয়। প্রায় এক দশক ধরে আমড়াপাড়া এলাকায় খনি খোঁড়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণের প্রতিরোধ চলছিল, সে আন্দোলন আমড়াপাড়া ছাড়িয়ে অন্যত্রও বিস্তৃত হয়েছে গোপীকান্দরে, রামগড়ের গ্রামে গ্রামে। আন্দোলন নানা পথ নিয়েছে, রূপবহুল রাজনীতির প্রভাবে, যার একটা দিক হল মাওবাদীদের সমর্থন প্রাপ্তি। অস্ত্রবল যে তাঁদের সমর্থন পেতে সাহায্য করেছে, সেটা যেমন ঠিক, আবার সাধারণ ভাবে যে কিছু লোকপ্রীতি তাঁদের অর্জিত হয়েছে, এটাও সত্য।

প্রতীক্ষা, যদি একটা গাড়ি এসে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায়।
নবপাহাড়ি গ্রাম, দুমকা। ডিসেম্বর ২০০৯। ছবি: মণি কেসরী
এখানে প্রকৃতি যতটা অকৃপণ, কল্যাণ রাষ্ট্র ততই সংকীর্ণ। গ্রামের পর গ্রামে রাষ্ট্রীয় সুবিধার খোপগুলোতে মোটা দাগে বসানো আছে ‘নেই’। স্থানীয় প্রবাদ, ‘ম্যালেরিয়াতে মানুষের মৃত্যু যেন টুপটুপ করে মহুয়ার ফুল ঝরা’। ডায়েরিয়া, কালাজ্বর থেকে শুরু করে নানান আধিব্যাধি অতি স্বাভাবিক! স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতেই একটা গোটা বেলা লেগে যায়। স্কুল? তেমন একটা ব্যাপার আছে বটে, কিন্তু ‘না মাস্টার, না লেখাপড়া!’ রেশন ব্যবস্থা? ‘দুপুর রোদে যতটুকু তারা দেখতে পাওয়া যায়! আমাদের চোখ থেকে যতটা জল পড়ে, ততটাও কেরোসিন পাই না।’ ক্ষুধা, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য যেন এখানকার সাঁওতাল-পাহাড়িয়াদের জন্মপূর্ব অভিশাপ। তার চেয়ে বড় অভিশাপ: মহাজন। আষাঢ়-শ্রাবণে কর্জ নেওয়া এক মণ ধানের বদলে দেড় মণ ধান ফেরত দিতে হয় অঘ্রান-পৌষে। এমন নয় যে, এঁদের এই দুর্দশা দূর করতে কোটি কোটি টাকা লাগে। যা লাগে তা হল, এঁদের সহনাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া। দুমকায় আদিবাসী মেয়েদের সংগঠন আয়ো-আয়দরি ট্রাস্ট ও প্রতীচী ট্রাস্টের চালানো যৌথ একটা প্রকল্পে দু’বছরে যৎসামান্য খরচে পাঁচ হাজার জনসংখ্যাবিশিষ্ট আটটি গ্রাম থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা গিয়েছিল।
রাষ্ট্র খরচের ব্যাপারে ততটা অরাজি নয়, যতটা সে অনড় এই লোকসম্প্রদায়কে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে। ওরা যে মানুষ, সেই বোধটাই ‘অপর’ শাসিত রাষ্ট্রের গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রান্তে ফেলে রাখা এই লোকেরা, যাঁদের রাষ্ট্রীয় নীতি ও সঞ্চালনে কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই, অথচ রাষ্ট্র নির্মাণে যাঁদের ঘাম-রক্ত অপরিহার্য, তাঁরা ম্যালেরিয়া, অনাহার, মহাজনী শোষণও হয়তো স্বাভাবিক বলে মেনে নেন, নানান বিশ্বাস-সঞ্জাত সান্ত্বনায় আত্মপ্রবঞ্চিতও হন। কিন্তু অমর্যাদার মাত্রা জীবনের সব সীমা অতিক্রম করে তাঁদের একান্ত নিজস্বতাটুকুও গ্রাস করতে চাইলে, তাঁদের একমাত্র আশ্রয়, জমি, জঙ্গল থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করে দেওয়ার চেষ্টা হলে তাঁদের তো কোনও উপায় থাকে না। তাঁদের সামনে বেঁচে থাকার অন্য কোনও বিকল্পই তো নেই। যে বিকল্পের কথা তাঁদের শোনানো হয়, তার স্বপ্ন দেখারও সক্ষমতাটুকু অর্জনে রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজের বিন্দুমাত্র অবদান নেই। পরম্পরায় গড়ে ওঠা এই নির্বিকল্প জীবন কতটা কাঙ্ক্ষিত, কতটা সভ্যতানুগামী, তা বিতর্কিত হলেও এঁদের নিরুপায়তা নিয়ে সন্দেহের উপায় নেই। সর্বনাশের এই তীরে যখন একটা পক্ষ তাঁদের একটা সহমর্মিতা জানায়, আক্রান্ত সময়ে সে পক্ষ কে, তারা ঠিক না ভুল, তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয় কী, এত প্রশ্ন করার অবকাশ থাকে না। মানুষ থিতু হওয়ার খোঁজে ঝাঁপিয়ে পড়ে অশান্তির তীব্রতায়। মাওবাদীরা নিমিত্তমাত্র। অথবা তারাও ক্রীড়নক। খেলার নিয়ম, সময় ও প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক আমাদের ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’, মানব-অকল্যাণ যার জীয়নকাঠি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.