মিটিং-মিছিলে জাতপাত নিয়ে পাঁতি দেওয়ার নব্যন্যায়ী তর্কাতর্কি কাগজপত্রে বেশ জমে উঠেছে। মার্ক্স বলেছিলেন, প্রথম বারের ট্র্যাজেডি পরের বার অলীককুনাট্য হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু বলেননি প্রথম বারটাই যদি অলীককুনাট্য ঘটে, পরের বার তার আকার কী হয়।
আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক শাস্ত্রীয় ঔচিত্যবোধের সাম্প্রতিক সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন এই রাজ্যের শাসক দলের প্রধানতম নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বক্তব্য সরাসরি জনসাধারণকে জানাতে জনসভাকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজ্যের আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জনসভাকে এই উদ্দেশ্যে অবলম্বন করেননি। প্রফুল্ল ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সাত জনের মধ্যে চার জন জনসভার বক্তা হিসেবে ভাল ছিলেন না। তিন জন যোগ্য বক্তা ছিলেন। কিন্তু অজয় মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেবও জনসভায় বক্তৃতা করতেন কোনও একটা বিশেষ রাজনৈতিক ইস্যুতে, আর সেই জনসভা ডাকত প্রধানত তাঁদের পার্টি বা ফ্রন্ট।
স্বাধীনতা আন্দোলনের গাঁধী পর্বেই প্রধানত জনসভা একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। সঙ্গে রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। হয়তো, এর প্রথম লক্ষণ দেখা গিয়েছিল স্বদেশি যুগে। হয়তো, এই প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে বামপন্থী আন্দোলনের সক্রিয়তাও ছিল যথেষ্ট। যাঁরা আজকাল কথায় কথায় পশ্চিমবঙ্গের অহর্নিশ মিটিং-মিছিল ও অবরোধ-বন্ধকে বাঙালির কর্মবিমুখ আলস্যপ্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে জাহির করেন, তাঁদের হয়তো এটুকু ভেবে দেখা দরকার যে, এটা বাঙালির খুব মূল্যার্জিত অভ্যাস। তার জন্য দাম কিছু কম দিতে হয়নি। এই স্বভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঙালি
সমাজকে চিনে নেওয়া যাবে না। বিভিন্ন রাজ্যের উন্নতি-পশ্চাৎপদতার তুলনাজ্ঞাপক সন্দেহজনক সংখ্যাতত্ত্বে এই হিসেবটা ধরা পড়ে না। |
শরিক। কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা। ২১ জুন, ২০১৩। ছবি: সুপ্রতিম চট্টোপাধ্যায় |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই যে দুটো অভ্যাস চালু করেছেন, জেলা সফর ও জনসভা, তার সঙ্গে তাঁর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি পাল্লা দিতে পারছে না। দিদির মিটিং মফস্সলে একটা জন-উৎসাহ তৈরি করে অনেক কথা শোনা যাবে, অভাব-অভিযোগের কথা বলা যাবে, কিছু হয়তো প্রতিকারও ঘোষণা হবে, আর বাড়তি পাওনা হিসেবে কিছু সাইকেল বা কম্বল বা ল্যাপটপও পাওয়া যাবে হয়তো। শেষেরটি কোথাও কোথাও মিডিয়ার দৌলতে প্রাধান্য পায় বটে, কিন্তু সমাবেশগুলি শুধু কিছু পাওয়ার জন্য, এ কথা বলে সেগুলিকে খাটো করা বস্তুত জনসাধারণের রাজনৈতিক সচেতনতাকে খাটো করা।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তাঁর জনসভাগুলির এই রাজনৈতিক তাৎপর্যকে তুচ্ছ করে ফেললেন। তিনি মিডিয়া ও প্রথাগত প্রচার ব্যবস্থার বিপরীতে তাঁর এই জনসভাগুলিকে তৈরি করে তুলেছিলেন। তিনি নিজেই সেগুলিকে বদলে ফেললেন তাঁর দেওয়ান-ই-খাস-এ। ঝাড়গ্রামের জনসভায় এক যুবক তাঁকে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। মমতা পুলিশকে নির্দেশ দেন যুবকটিকে ধরতে। বলেনও, যুবকটি মাওবাদী। পুলিশ যুবকটিকে ধরল, থানা-পুলিশ হওয়ার পর জানা গেল, যুবকটি সারের দাম বাড়ছে কেন জানতে চেয়েছিলেন। এই সে দিন কামদুনিতে দুটি মেয়ে তাঁকে কিছু বলার উদ্যোগ করছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বলেন, ‘চোপ’। তারও পর এক জনসভায় তাঁর বক্তৃতার সময় সভার ভিতরে দু-তিনটি মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তিনি নিজের বক্তৃতা থামিয়ে তাঁদের চুপ করতে বলেন। মিটিঙের পর তিনি তাঁদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানেন তাঁদের কিছু নিজস্ব কথা। ওই মিটিঙে যে তিনি পরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেটা মনে হয় কামদুনির অবিমৃশ্যকারিতার সংশোধন। নেতাদের আত্মসংশোধন স্বস্তি দেয়। কিন্তু জনসভার ভাষণ মারফত জনসংযোগের এই প্রক্রিয়াকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেনে বা না-জেনে নিজেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ফেলছেন।
এক এক পুজোর এক এক নৈবেদ্য। সব পুজোয় সব বাদ্যি চলে না। বাড়ির মধ্যে শনি বা যমপুজো হয় না। জনসভা যখন ডাকা হচ্ছে ‘দলে দলে যোগ দিন’ বলে, তখন সভায় যাঁরা আসছেন, প্রত্যেকটি মানুষেরই মর্যাদা সেখানে ‘আমন্ত্রিত’র। একে তো দশ-বারো ফুট উঁচু মঞ্চ, নিরাপত্তার বর্গ অনুযায়ী উচ্চতার হেরফের, তার ওপর জনতার প্রথম সারি থেকে বন্দুকের গুলির গতিবেগ অনুযায়ী ৫০ ফুট দূরত্ব। তার ওপর নেতাদের ওজন অনুযায়ী দ্বিমুণ্ড বা ত্রিমুণ্ড দেহরক্ষী। আর কত নিরাপত্তা দরকার নেতাদের? সব দলেরই নেতাদের?
যে জনসাধারণ ছাড়া তাঁদের চলবে না, তাদেরই কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব তাঁরা আর কত বাড়াবেন?
জনসভা ডাকার পর সেই জনসভার কোনও শ্রোতাকে কি জিজ্ঞাসা করা যায়, ‘আপনি কেন এসেছেন?’ কোনও মিছিল ডাকার পর সেই মিছিলে-আসা কাউকে কি জিজ্ঞাসা করা যায় ‘আপনি কেন এসেছেন?’ কোনও মিছিলে কেন যাব না এই জিজ্ঞাসার কৈফিয়তে কি কেউ বলতে পারেন: ওই মিছিল যাঁরা ডেকেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দু’বছর আগে নন্দীগ্রাম-হত্যা-বিরোধী মিছিলে হাঁটেননি? কোনও মিছিল কেন পার্টি-মিছিল নয়, তার যুক্তি হিসেবে কি দু’চার জন পার্টি-চিহ্নিত ব্যক্তির নাম তুলে বলা যায়: ওঁরা যে-মিছিলে আছেন, সে মিছিল কী করে পার্টি-নিরপেক্ষ হয়?
আমি নন্দীগ্রামের মিছিলে যাইনি সে দিন। বামফ্রন্টের মিছিলে গিয়েছিলাম সে দিন। ও-রকম ঘটনা আবার ঘটলে আবারও আমি ও ভাবেই আমার মিছিল বাছব। আমার অতি ঘনিষ্ঠ এক অনতিতরুণ দম্পতির স্ত্রী সে দিন গিয়েছিলেন বামফ্রন্টের মিছিলে, স্বামী গিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের মিছিলে। এই সে দিন কিন্তু তাঁরা দু’জনই একসঙ্গে এসেছিলেন কামদুনির মিছিলে। দেখা হল। দেখা হল এমন দু’জন বন্ধুর সঙ্গে, যাঁদের পক্ষে শারীরিক কারণে দশ পা-ও হাঁটা সম্ভব নয়। সম্পর্কে তাঁরা বেয়ান। সঙ্গে নাতনিকে নিয়ে এসেছেন। একটু উদ্বেগ ছিল বোধহয় আমার গলায়, ‘হাঁটবেন নাকি?’ তাঁরা গোলদিঘির গেটে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বকে দিলেন, ‘হাঁটতে পারি না বলে কি মিছিলে আসব না?’ এঁদের দু’জনই বছর দুয়েক আগে নন্দীগ্রামের বামফ্রন্টের মিছিলে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভিজেছিলেন।
যাঁরা কামদুনির মিছিলকে নন্দীগ্রাম-বিরোধী মিছিলের সঙ্গে তুলনা করেন ও দলতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে স্বতন্ত্র এক দলমুক্ত নাগরিক রাজনীতির কথা বলেন, বা যাঁরা কে কে ছিলেন তার তালিকা দিয়ে নিজের থাকার পরোক্ষ যুক্তি নির্মাণ করেন এই উভয় পক্ষের মনোভাব পরস্পরের পরিপূরক। তাঁদের কারওই মনে থাকে না কামদুনির সেই মেয়েটি। সে-ই তো ওই মিছিলটিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ওই মিছিল তো হওয়ার কথা নয়। কেন হবে? কলেজ থেকে ক্লাস করে ঘরে-ফেরা-মেয়ের তো চোখ বুজে ঘরেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। ঘরের কাছে একদল মাতাল জুয়াড়ি মেয়েটাকে লুট করে নিয়ে মেরে ফেলল? যদি কেউ ডেকে বলেন, এসো, একসঙ্গে বসে আমরা কাঁদি; যাব না?
যাবই, যদি আমার চোখে একাকী জল থাকে। যাবই, মেয়েটির বয়সি নাতনিকে নিয়ে যাব, মিছিলে, কাঁদতে শেখাব। নিজে হাঁটতে না পারলেও সকলের সঙ্গে কাঁদা যায়।
সেই সমবেত আত্মদহনের কান্নার বিচার যাঁরা করেন গণতান্ত্রিক সমাজ, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সমাজ, বিদ্বজ্জন সমাজ, পরিবর্তনপন্থী সমাজ, পরিবর্তনের পরিবর্তনপন্থী সমাজ তাঁদের চোখ কান্না ভুলে গেছে।
আমরা বরং কান্না খুঁজি। |