দেশের সর্বপ্রান্তে যখন মেয়েরা অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হইতেছেন, তখন দুই মাস তিন সপ্তাহ হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকা অপরাধ। কেন্দ্রীয় সরকার এই অপরাধটিই করিয়াছে। এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট আদেশ করিয়াছিল, যাহাতে অ্যাসিড সহজলভ্য না হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে এবং অ্যাসিড-আক্রান্ত মহিলাদের পুনর্বাসনের যথেষ্ট ব্যবস্থা করিতে হইবে। দুই মাস তিন সপ্তাহ পরে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী আদালতে জানাইলেন, আরও সময় প্রয়োজন। আদালত সঙ্গত কারণেই বিরক্ত হইয়াছে। মাননীয় বিচারপতি তীব্র ভর্ৎসনা করিয়া বলিয়াছেন, সরকারের বিষয়টিকে যে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তাহা চোখে পড়িতেছে না। আরও বলিয়াছেন, সরকার অবিলম্বে সক্রিয় না হইলে আদালত অ্যাসিড বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করিবে। এই ক্ষোভ এবং হতাশা সঙ্গত। প্রথমত, সমস্যাটি কার্যত মহামারিসম। উত্তর-দক্ষিণ নির্বিশেষে, গ্রাম-শহর ভেদহীন ভাবে মেয়েরা আক্রান্ত হইতেছেন। বর্বরদের নিকট এই আক্রমণ ‘সুবিধাজনক’ দূর হইতে অ্যাসিড ছুড়িয়া পলাইলেই হয়, ধরা পড়িবার ঝুঁকি কম। ফলে, অস্ত্রটি ‘জনপ্রিয়’ হইতেছে। বিশেষত, অ্যাসিড প্রায় জলের মতোই সহজলভ্য, এবং সস্তা। দ্বিতীয়ত, সরকার সমস্যাটির গুরুত্বই অনুধাবন করিতে পারে নাই। ফলে, আদালত যে তৎপরতা এবং কঠোরতা প্রত্যাশা করিয়াছিল, সরকার তাহার ধারেকাছেও পৌঁছায় নাই। এই অ-সংবেদন শুধু সরকারের নহে, ইহা বৃহত্তর সমাজের প্রতিফলনমাত্র। এই পরিস্থিতিতে হতাশ বোধ করাই স্বাভাবিক।
শীর্ষ আদালতের তিরস্কারের অন্তর্নিহিত আবেগটির গুরুত্ব শিরোধার্য। কিন্তু বিনীত ভাবে একটি প্রশ্ন পেশ করা প্রয়োজন অ্যাসিড বিক্রয় নিষিদ্ধ করাই কি যথার্থ পথ হইতে পারে? অনস্বীকার্য, সরকার যে গয়ংগচ্ছ মনোভাবের নজির পেশ করিয়াছে, তাহাতে অ্যাসিড বিক্রয় সম্পূর্ণ বন্ধ না করিয়া কী ভাবে মেয়েগুলিকে বাঁচানো সম্ভব, তাহা ভাবিয়া উঠা কঠিন। কিন্তু সরকারের গয়ংগচ্ছতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রয়োজন নাই। অ্যাসিড আক্রমণের অপরাধীকে গ্রেফতার করা সরকারের কর্তব্য কোনও অজুহাতেই সেই কর্তব্য পালনে অবহেলা সহ্য করা হইবে না। বস্তুত, অ্যাসিড-আক্রমণকারীকে শনাক্ত করা এবং গ্রেফতার করা সহজ প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই এই আক্রমণের পশ্চাতে পূর্ব-বিদ্বেষ থাকে। আক্রমণকারীকে গ্রেফতার করিয়া দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হউক— কঠোর, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান হউক। অনুমান করা সম্ভব, অধিকাংশ পুলিশকর্মীই অ্যাসিড আক্রমণকে ধর্ষণের মতোই গুরুতর অপরাধ বলিয়া বিবেচনা করেন না। মেয়েদের শাস্তি দেওয়া পুরুষতন্ত্রে পুরুষের অধিকার হিসাবেই স্বীকৃত। এই মানসিকতার সংস্কার প্রয়োজন। পুলিশকর্মীদের বুঝাইতে হইবে, অপরাধের গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন করিতে হইবে। ভুলিলে চলিবে না, অ্যাসিড অস্ত্রমাত্র, যে মানসিকতা সেই অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহাকে দমন না করিয়া অস্ত্র লুকাইয়া রাখিলে লাভ হইবে না। নূতন অস্ত্র জোগাড় করা তেমন কঠিন নহে। |