রথ দেখতে আর রথের রশি টানতে ভিড় উপচে পড়ল শিল্পাঞ্চলে। কচিকাচা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই পুজো, আরতির সঙ্গে সঙ্গে সমান ভিড় জমালেন রথের মেলায়। ঝিপঝিপে বৃষ্টিকে তুড়িতে উড়িয়ে পাঁপড় আর জিলিপিতে জমে গেল রথযাত্রা।
বছরের পর বছর ধরে দুর্গাপুরে শহরের সবচেয়ে জাঁকজমক রথযাত্রার আয়োজন করে আসছে ইস্পাত নগরীর রাজেন্দ্রপ্রসাদ রোডের জগন্নাথ মন্দির কর্তৃপক্ষ। মেলা বসেছে রাজীব গাঁধী স্মারক ময়দানেও। প্রতিবারের মতো এ বারও, বুধবার বিকালে জগন্নাথ মন্দির থেকে রথে করে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেলার মাঠে। তাঁরা আবার মন্দিতে ফিরবেন উল্টোরথের দিন। মেলায় ভেঁপু, পাঁপড়, ফুচকা থেকে শুরু করে জামাকাপড়, টিভি, কম্পিউটার সবেরই স্টল বসেছে। বিক্রিও হচ্ছে দেদার। বসেছে বই মেলাও। মেলা কতৃর্পক্ষ জানিয়েছেন, প্রতি সন্ধ্যাতেই পালাকীর্তন, বাউল, কবিগানের আসরে গমগম করবে মেলা ময়দান।
শহরের সিটিসেন্টারে এ বারই প্রথম রথযাত্রার আয়োজন করল ইসকন কর্তৃপক্ষ। সকালে নেতাজি সুভাষ বসু রোডের মন্দিরে হাজির ছিলেন রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। রথের যাত্রাপথের কিছুটা ঝাঁটও দেন তিনি। দুপুরে দড়ি টেনে রথযাত্রার উদ্বোধন করেন মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যায় রথ এসে পৌঁছায় সিটি সেন্টারের চতুরঙ্গ মাঠে। এছাড়া মামরা বাজার, ডিটিপিএস কলোনি শিবমমন্দির, সাধুডাঙা এলাকাতেও সাড়ম্বরে রথযাত্রা আয়োজিত হয়েছে। |
শহরের বাইরেও সমান তালে দেখা গেল রথযাত্রা। পাড়ার ছেলেমেয়েদের হাতে সাজানো রথ থেকে শুরু করে মন্দিরের রথ, সবেতেই সাগ্রহে যোগ দিলেন মানুষ। মানকরের দক্ষিণ রাইপুর গোস্বামী পাড়ার আকর্ষণ শতাব্দী প্রাচীন একটি পিতলের রথ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এলাকার মানুষ যোগ দেন এই রথযাত্রা। সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, প্রায় দেড়শো বছর আগে মানকরে লক্ষ্মী জনার্দন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন গর্ন্ধব্য কর। এক শতাব্দী আগে এই রথযাত্রার পত্তন করেছিলেন মাধবচন্দ্র কর। বাংলা ১৩১৮ সালে পিতলের প্রায় সাড়ে ৯ ফুট উচ্চতার রথটি নির্মাণ করেন স্থানীয় শিল্পী কেদারনাথ দে। সেই রথেই আজও ঘোরানো হয় গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে। রাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে।
কাঁকসার বনকাটি গ্রামেও প্রায় দু’শো বছরের পুরনো আট চাকার উপর পঞ্চরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি কুড়ি ফুট উঁচু একটি রথকে ঘিরে উন্মাদনা দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাংলা ১২৩৯ সালে মুখোপাধ্যায় পরিবারের এক সদস্য গ্রামে এই রথ প্রতিষ্ঠা করেন। বাড়ির পাশে ছিল গৃহদেবতা গোপাল জিউ-এর মন্দির। সেই মন্দিরের আদলে পিতলের রথ তৈরি হয়। রথের গায়ে নিপুণ হাতে শিল্পীরা খোদাই করেন পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের ঘটনাবলী।
আসানসোলেও শিল্পাঞ্চলের একাধিক উৎকল সমাজ ধুমধামের সঙ্গে রথযাত্রার আয়োজন করেছিল। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো কুলটির উৎকল সমাজের রথযাত্রা উৎসব এবার কিছুটা ম্লান হলেও ভক্তিতে ত্রুটি ছিল না। জাঁকজমকে পালিত হয় বার্নপুরের উৎকল সমাজের রথযাত্রা। নতুন করে সাজানো হয় মন্দির চত্বর। কুলটির কেন্দুয়া বাজার এলাকাতেও প্রায় শতাধিক বছরের পুরনো রথযাত্রা ঘিরে ছোটখাট মেলা বসে। চিত্তরঞ্জনের আর সাইট উৎকল সমাজ তাদের স্থায়ী মন্দিরে পুজো আরতিতে পালন করে দিনটি। এলাকার ৬ এর পল্লিতেও রথযাত্রা উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে। বরাকরের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের সীতারাম বাবার আশ্রমেও রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বেশ ভিড় হয়। কুলটির মানিকেশ্বরে প্রায় তিনশো বছরের পুরনো রথ এলাকায় সাড়া ফেলে। বড় বড় রথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেরিয়েছে ছোট-বড় নানা রঙের রথও।
তবে জমিদার বাড়ির রথগুলিতে জগন্নাথ নয় চাপেন কূলদেবতারা। অন্ডালের উখড়া জমিদারবাড়ির লালসিংহ হাণ্ডে বাড়ির রথে বসেছিলেন তাঁদের কুলদেবতা গোপীনাথজি। ১৭২ বছর আগে এই পরিবার দুটি রথ বের করত। ২৫ বছর আগে ছোট রথের কয়েকটি চাকা ভক্তিদের চাপে ভেঙে যাওয়ায় পরের বছর থেকে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন কেবল ২৫ ফুটের বড় রথটি চলে। দুটিই পিতলের। তবে রথ আর দড়ি দিয়ে নয়, টানে ট্রাক্টর। ১২ বছর ধরে এমন হয়ে চলেছে। রানিগঞ্জের সিহারশোল রাজবাড়িতেও প্রতি বারের মতো ধুমধাম করে পালিত হয় রথযাত্রা। জেলার নানা প্রান্ত থেকে রথের রশি টানতে ভিড় করেন ভক্তরা। ১৮৩৬ সালে এই রথযাত্রা শুরু করেন তৎকালীন জমিদার তথা সিহারসোল কোলিয়ারির মালিক গোবিন্দ প্রসাদ। পরে মেয়ের ইচ্ছায় শ্রীরামপুরের মাহেশের রথের অনুকরণে পিতলের রথ বানানো হয়। রথে চাপেন কুলদেবতা দামোদর চন্দ্র শিলা। রথ টানে দুটি লরি। বসে মেলাও। কুলটির বেলরুইয়ের জমিদার বাড়ি রায় পরিবারের রথও ঐতিহ্যবাহী। রথে চড়ানো হয় জনার্দনকে। ওই বাড়ির সদস্য তথা কুলটি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান বাচ্চু রায় বলেন, “অতীতের ঐতিহ্য এখন ইতিহাস। তবে এখনও মানুষের ঢল নামে।” |