রাজ্যের মাওবাদী-প্রভাবিত তিন জেলায় পঞ্চায়েত ভোটের জন্য কলকাতা পুলিশের কর্মীদের পাঠানো নিয়ে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে লালবাজারের চাপানউতোর শুরু হয়েছে।
সোমবার বাঁকুড়ার পুলিশ লাইনে ভোটের ডিউটিতে যাওয়া কলকাতা পুলিশের অফিসার ও কনস্টেবলদের একটা বড় অংশ মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় যাবেন না বলে বেঁকে বসেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, মান্ধাতা আমলের ‘থ্রি নট থ্রি’ রাইফেল হাতে দিয়ে তাঁদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তবে এ প্রসঙ্গে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর কিছুই জানে না বলে দাবি করেছে। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “জঙ্গলমহলে যেতে কলকাতা পুলিশের কর্মীদের আপত্তি কথা সরকার জানে না। সংবাদপত্রেই জেনেছে। যদি এমন কিছু ঘটে থাকে এবং সরকারি রিপোর্ট আসে, তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বাঁকুড়ার মতো ‘বিদ্রোহ’ না-হলেও পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়াতেও কলকাতা পুলিশের কর্মীদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে অসন্তোষ ঘনাচ্ছে বলে খবর। বাঁকুড়ার পুলিশ মুকেশ কুমার অবশ্য বলেন, “কলকাতা পুলিশের কর্মীরা জঙ্গলমহলে যেতে চাইছেন না বলে আমার কাছে খবর নেই। যেখানে যত পুলিশ পাঠানোর দরকার ছিল সুষ্ঠু ভাবেই পাঠানো হয়েছে।” পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি সুনীল চৌধুরীরও একই বক্তব্য। |
বাঁকুড়ার রাইপুরের মটগোদা গার্লস হাইস্কুলে কলকাতা পুলিশের শিবির। —নিজস্ব চিত্র |
কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তাদের কিন্তু যুক্তি, ওই তিন জেলায় মাওবাদী প্রভাবিত নয়, এমন অনেক থানা রয়েছে। সেখানে কলকাতা পুলিশের কর্মীদের মোতায়েন করাটাই প্রত্যাশিত। তাঁদের যুক্তি, “কলকাতা পুলিশ মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভিআইপি ডিউটি করতে অভ্যস্ত। তাদের হঠাৎ থ্রি নট থ্রি রাইফেল ধরিয়ে মাওবাদী এলাকায় পাঠালে অসন্তোষ হবেই। বিএসএফ-কে যদি কলকাতার ট্রাফিক সামলাতে বলা হয়, সেটা কি ঠিক?” সংশ্লিষ্ট তিন জেলার পুলিশ কর্তাদের অবশ্য বক্তব্য, মাওবাদী এলাকার বাইরেও কলকাতা পুলিশের বহু কর্মীকে ডিউটি দেওয়া হয়েছে।
লালবাজারের শীর্ষকর্তাদের আরও দাবি, “কলকাতার পুলিশকর্মীদের অনেককেই বাঁকুড়া জেলা পুলিশ থেকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি ‘থ্রি নট থ্রি’ রাইফেল অকেজো ছিল। তাতেই কলকাতা পুলিশের লোকজন বেশি খাপ্পা হয়ে যায়।” যদিও বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “এ রকম কিছু ঘটেনি। যদি কোনও অভিযোগ থেকেও থাকে, তাহলে তো আমাদের এসপিকেই আগে জানানোর কথা। কিন্তু তা হয়নি।”
২০০৯ সালে জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরুর পর কলকাতা পুলিশ থেকে প্রায় ৫০০ জনকে পাঠানো হলেও অভিযানে নামানো হয়নি। তবে মাওবাদী-প্রভাবিত জেলা তো বটেই, কলকাতা থেকে এত দূরে পুলিশকর্মীদের ভোটের ডিউটিতে এই প্রথম পাঠাল লালবাজার। এর আগে কলকাতা সংলগ্ন জেলাতেই কলকাতা পুলিশ ভোটের ডিউটি করেছে। এ বার ওই তিন জেলায় ছ’হাজারেরও বেশি পুলিশ পাঠিয়েছে লালবাজার।
এই সংখ্যাধিক্যটাই সমস্যার অন্যতম কারণ বলে ওই তিন জেলার পুলিশকর্তাদের মত। জঙ্গলমহলের একটি থানার আইসি বলেন, “এঁরা তো মহানগরের পুলিশ। যে সুযোগ-সুবিধা কলকাতায় পেতে অভ্যস্ত, তা এখানে পাবেন কী করে?” বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক কর্তার এ-ও অভিযোগ, “যে-সব পুলিশকর্মী জঙ্গলমহলে না যাওয়ার গোঁ ধরে বিষ্ণুপুর মহকুমার বিভিন্ন থানা এলাকায় ডিউটিতে গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখন জঙ্গলমহলে থাকা সহকর্মীদের ফোন করে নানা ভাবে সেখান থেকে চলে যেতে প্ররোচিত করছেন।” জঙ্গলমহলে কলকাতা পুলিশকে পাঠানোর আগে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি লালবাজারের মাথায় রাখা উচিত ছিল বলেও মনে করছে রাজ্য পুলিশ।
এই প্রসঙ্গেই ফের সামনে এসেছে কলকাতা পুলিশের আধুনিকীকরণ ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি। স্পেশ্যালাইজ্ড অ্যাকশন ফোর্স, কমান্ডো এবং কলকাতা পুলিশের সশস্ত্র বাহিনীর একাংশ ছাড়া এ কে-৪৭, ইনস্যাস, এসএলআর, এক্স-৯৫ গ্লক পিস্তলের মতো আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র কলকাতা পুলিশের হাতে নেই। কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, “সব কিছু রাতারাতি হবে না।” |