গত বারে তীরে এসে তরী ডুবেছিল। এ বার তাই অহি-নকুল হাত ধরাধরি। পুরুলিয়া ১ ব্লকের মানাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট গড়েই এ বার ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছে। দু’দলের রাজ্য নেতৃত্বের সম্পর্ক ক্রমশ তলানিতে ঠেকলেও এখানে তৃণমূল স্তরে উল্টো ছবি। তৃণমূল ও কংগ্রেসের কর্মীর একসঙ্গে প্রচারে বের হচ্ছেন। একসঙ্গেই তাঁরা দেওয়াল লিখছেন, পোস্টার সাঁটাচ্ছেন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরস্পর বিরোধী দলকে আগেও স্থানীয় ভাবে জোট গড়ে লড়তে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্য। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতা দখল করলেও, পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষের সম্পর্কে ভাঙন ধরে। শুধু রাজ্যেই নয়, কেন্দ্র সরকার থেকেও কংগ্রেসের পাশ থেকে সরে আসে তৃণমূল। পুরুলিয়া জেলাতেও ১৭০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে শুধু এখানেই ওই দুই দল জোট গড়েছে। এখানে জোট গড়ার কারণ কী? নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি এবং কর্মীদের চাপেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। রাজনৈতিক শত্রুতার চেয়ে এখানে অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বাস্তব পরিস্থিত। যে বাস্তব বলছে, বামফ্রন্টকে বেগ দিতে গেলে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট করতেই হবে। |
এই গ্রাম পঞ্চায়েতে একবারই কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। সেটা ১৯৭৮ সালে। তারপর থেকে আর কংগ্রেস এই পঞ্চায়েতে ফেরেনি। বরা বর পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ধরে রেখেছে বামপন্থীরা। প্রতিবার বাম বিরোধীদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। গত বার ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়েও শেষ হাসি হাসতে পারেননি বাম বিরোধীরা। মোট ১০ আসনের এই পঞ্চায়েতে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৫টি, অন্য দিকে, কংগ্রেস ৩ এবং তৃণমূল ও নির্দল ১টি করে আসন পায়। দু’পক্ষ পাঁচটি করে আসন পাওয়ায় শেষে টস হয়। টসে জেতে সেই বামপন্থীরাই। পরে যে পরিস্থিতি বদলেছে, তার প্রমাণও নেই। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে এই এলাকা থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন কে পি সিংদেও। সামগ্রিক ভাবে পুরুলিয়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি ২৬ হাজারের বেশি ভোটে বামফ্রন্ট প্রার্থীকে হারান। কিন্তু এই পঞ্চায়েতে কে পি সিংদেও বামফ্রন্টের প্রার্থীর তুলনায় কম ভোট পেয়েছিলেন।
এ বার তাই ছক বদলে হাত ধরাধরি করেন স্থানীয় তৃণমূল ও কংগ্রেস নেতৃত্ব। তৃণমূলের মানাড়া অঞ্চল সভাপতি অনিল মাহাতো বলেন, “এই পঞ্চায়েতে ক্ষমতা কবে বাম বিরোধীরা পেয়েছিলাম ভুলেই গিয়েছি।” |
বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটিতে
কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল। |
বাইক-মিছিলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচন কমিশনের।
অটো তো আছে! তৃণমূলের অটো-প্রচার বাঁকুড়ার আন্ধারথোলে। |
|
এই পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা তথা জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কৃত্তিবাস মাহাতো বলেন, “রাজ্য স্তরে সম্পর্ক যাই থাক না কেন, বলতে পারেন কর্মী ও বামবিরোধী ভোটারদের চাপে আমারা সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছি। তাঁরা চাইছেন ভোট ভাগাভাগির সুযোগে ফের যেন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় না আসে।” তিনি জানান, প্রথম থেকেই এই পঞ্চায়েত এলাকার বিভিন্ন গ্রামে কর্মীরা এ কথাই বলে আসছেন। তাই তাঁদের কথা ফেলতে পারেননি। আর দু’দলের কর্মীরা বলছেন, গত বার পঞ্চায়েত ভোটে দু’দলে জোট না হওয়ার খেসারত তাঁরা দিয়েছেন। এ বার তাই নেতাদের ধরে বেঁধেই তাঁরা জোটে সম্মতি আদায় করেছেন। তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি বলছেন, “আমরা দু’দলই এখানে সমঝোতা করে লড়ছি মূলত কর্মী ও বামবিরোধী ভোটারদের কথা মাথায় রেখে।”
দেওয়াল লিখনও শুরু করে দিয়েছেন কর্মীরা। এলাকার মাণিকডি, মিশিরডি, কেশরগড়িয়া-সহ বিভিন্ন গ্রামে দেখা গিয়েছে দেওয়াল লিখনে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান। ভাদসা গ্রামের কংগ্রেস কর্মী সুব্রত মাহাতো বলেন, “এ বার আমরা পঞ্চায়েতে ভাল ফল করব।” |
জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো এই ব্লকেরই বাসিন্দা। কোন সমীকরণে এই পঞ্চায়েতে তৃণমূল-কংগ্রেস সমঝোতা হল, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “বামফ্রন্ট যাতে সুবিধে না পায়, তার জন্য স্থানীয় নেতা-কর্মীরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেলায় কেবলমাত্র একটি গ্রাম পঞ্চায়েতেই এই সমঝোতা হয়েছে।” জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রথীন্দ্রনাথ মাহাতোর বক্তব্য, “স্থানীয় নেতা-কর্মীরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তাকে সমর্থন করেছি। যেহেতু এই সিদ্ধান্ত বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়ার প্রশ্নে নেওয়া হয়েছে।”
সিপিএমের পুরুলিয়া ১ জোনাল কমিটির সম্পাদক অনিল মাহাতো অবশ্য বলেছেন, “মানাড়া পঞ্চায়েতে এ বার ওরা একসঙ্গে লড়ছে। আমরা অতীতে এখানে ভাল ফল করেছি। এ বারও লড়ব। মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবেন বলেই মনে করি।” উল্লেখ্য, কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্লকের কেবলমাত্র এই পঞ্চায়েত এলাকার গোবিন্দপুরেই কর্মিসভা করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূযর্কান্ত মিশ্র।
বামফ্রন্টের টানা ছয় বারের গড় বনাম কংগ্রেস-তৃণমূলের সমঝোতা। অপেক্ষায় রয়েছে মানাড়া। |
ছবি: অভিজিৎ সিংহ ও সুজিত মাহাতো |