|
|
|
|
‘ওরা’ ফিরে আসায় কার লাভ, শাসক ও বিরোধীর তরজা জারি |
সুরবেক বিশ্বাস • নয়াগ্রাম |
তরকারির কাই মাখা কয়েকটা থার্মোকলের থালা ছড়ানো-ছিটোনো। তিনটে মশারির খুট বাঁধা গাছের গায়ে। রান্নার জন্য আগুন জ্বালানোর চিহ্নও স্পষ্ট। পাতিনা পঞ্চায়েতের রাঙামাটিয়া গ্রামের বাসিন্দারা পাতা কুড়োতে জঙ্গলে গিয়ে বহিরাগতদের রাত কাটানোর প্রমাণ পেয়ে কেমন যেন সিঁটিয়ে গিয়েছেন। বুঝেছেন, “ওরা ফের আসছে।”
দশ কিলোমিটারের মধ্যেই ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলা। ‘ওরা’ অর্থাৎ মাওবাদীরা যে পঞ্চায়েত ভোটের মুখে নয়াগ্রামে ফের আনাগোনা শুরু করেছে, সে কথা পুলিশ-প্রশাসনও জেনেছে বিলক্ষণ। এই অবস্থায় পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাঞ্চন নামে এক মাওবাদী নেতাকে ধরতে উঠেপড়ে লেগেছেন। গত অগস্টে মাওবাদীদের নয়াগ্রাম স্কোয়াড কমান্ডার রঞ্জন মুণ্ডা নয়াগ্রামেই ধরা পড়ার পরে কাঞ্চনই স্কোয়াডের দায়িত্বে বলে গোয়েন্দাদের খবর। কাঞ্চন কিন্তু নয়াগ্রামেরই ভূমিপুত্র। বাড়ি নয়াগ্রামের ইঞ্জিলিকা চকে।
এলাকায় মোতায়েন সিআরপি-র এক কর্তা জানান, দিন দশেক আগে বেলাশুলির জঙ্গল লাগোয়া সিজুয়া গ্রামের একটি বিয়েবাড়িতে কাঞ্চনের নেতৃত্বে ৩২ জন মাওবাদী খাওয়াদাওয়া করেছে। ওই কর্তার কথায়, “বিয়েবাড়িতে খেয়েদেয়ে তারা ফের বেলাশুলির জঙ্গলে ঢুকে যায়। ওই জঙ্গলে ওরা একটা ঘাঁটি তৈরি করেছে।” তা হলে কি নয়াগ্রামে পঞ্চায়েত ভোটের আগে বা ভোট চলাকালীন বড়সড় নাশকতার ছক কষছে মাওবাদীরা?
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বড় অংশের অবশ্য ধারণা, “জনগণের শান্তি বিঘ্নিত হোক, এই মুহূর্তে মাওবাদীরা হয়তো সে রকম কাজ করবে না। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটকে উপলক্ষ করে রাজনীতিতে পরোক্ষ প্রভাব খাটাতে চাইছে তারা।” এলাকা ঘুরে মনে হল, এই ‘ধারণা’ আদৌ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সিজুয়া গ্রামে কাঞ্চনের মামাবাড়ি। গ্রামটা বড়খাকরি পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। সেখানে ন’টি আসনের মধ্যে সিপিএম আটটিতে প্রার্থী দিয়েছে, একটিতে প্রার্থী সিপিআইয়ের। পঞ্চায়েত সমিতির দু’টি আসনের মধ্যে একটিতে সিপিএম ও অন্যটিতে সিপিআই লড়ছে। অথচ, নয়াগ্রাম ব্লকের মোট ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের এক দশমাংশ আসনে বামফ্রন্ট নিজের প্রতীকে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারেনি। পঞ্চায়েত স্তরে চারটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। বহু বুথে সেখানকার কোনও বাসিন্দাকে প্রার্থী করতে না পেরে তিন-চার কিলোমিটার দূরের এলাকা থেকে কাউকে প্রার্থী করতে বাধ্য হয়েছেন বামেরা। বড়খাকরিতে বামেদের শক্তির উৎস কী?
সিপিএমের নয়াগ্রাম জোনাল কমিটির সম্পাদক হিমাংশু ত্রিপাঠীর জবাব, “বড়খাকরির মতো এক সময়ে মাওবাদী-প্রভাবিত এলাকায় আমাদের পরিস্থিতি তুলনায় ভাল। কারণ, ওই সব জায়গায় স্থানীয় মানুষদের হাতে আমাদের সংগঠনের দায়িত্ব পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি। এলাকার মানুষ রাজ্যে শাসক দলের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। তাই তৃণমূল ওই সমস্ত জায়গায় তেমন ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে নামতে পারছে না।”
২০০৯-এর গোড়া থেকে ২০১০-এর মে-জুন পর্যন্ত নয়াগ্রামের একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে পারেনি সিপিএম। দলের হিসেবে, ওই সময় তাদের ১৫ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন মাওবাদীদের হাতে। পাতিনা, চাঁদাবিলা, মলম, বড়খাকরিএই সব এলাকায় মাওবাদীরা সে সময়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল বলে এখনও অভিযোগ করেন সিপিএম নেতারা। এখন তাদের ফেরত আসার সঙ্গে তৃণমূলের বাধা পাওয়ার কি কোনও সম্পর্ক আছে?
“আছে”, দাবি তৃণমূলের নয়াগ্রাম ব্লক সভাপতি উজ্জ্বল দত্তের। তাঁর বক্তব্য, “সিপিএম তো ময়দানেই নেই। তবে কয়েকজন মাওবাদী ও জনসধারণের কমিটির প্রাক্তন নেতা সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তারাই ঝামেলা পাকাতে চেষ্টা করছে।” হিমাংশুবাবু অবশ্য বলেন, “হাস্যকর কথা। সবাই জানে, জঙ্গলমহলে কে কাকে মদত দিয়েছিল।”
পাতিনা থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে পাঁচ কাহানিয়ার মতো ‘বিপজ্জনক’ জঙ্গল লাগোয়া বড় নেগুই গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট সাতটি আসনের সব ক’টিতে ও দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনেও প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম। বড় নেগুই গ্রামের ঝর্ণা সিংহ, অভিরাম সিংহেরা বলেন, “এখন কোনও গোলমাল নেই। শান্তিই আছে এলাকায়।”
তা বলে ‘বনপার্টি’ (মাওবাদী) আসছে না?
জবাব আসে না। দম্পতি চোখ নামিয়ে তাকিয়ে থাকেন লালমাটির দিকে।
|
পুরনো খবর: আড়ালে ওদের নজর, স্বস্তিটা অস্বস্তি পুরুলিয়ায় |
|
|
|
|
|