এখনও পর্যন্ত কোনও বড় ধরনের গণ্ডগোল নেই। মাওবাদী হানা নেই। রাজ্যের আর পাঁচটা জায়গার চেয়ে লাল মাটির দেশ পুরুলিয়ায় পঞ্চায়েত ভোটের তোড়জোড় এখনও অনেকটাই শান্তিপূর্ণ। আপাত ভাবে স্বস্তিরও।
সত্যিই কি তা-ই? পুলিশ-প্রশাসন, নেতাদের একাংশ, সাধারণ মানুষের অনেকের সঙ্গে কথাবার্তায় যা উঠে এল, তার নির্যাস পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রার্থী বাছাই থেকে মনোনয়ন, প্রতিটি পর্বে গোপন ডেরা থেকে নজর রেখে চলেছে মাওবাদীরা। নিজেদের অধ্যুষিত এলাকায় প্রয়োজনমতো প্রভাব খাটাচ্ছে তারা। যে প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলছেন, এমন কাণ্ড বিধানসভা ভোটেও দেখা গিয়েছে। ফিসফিস করে স্থানীয় বাসিন্দাদের দু-এক জন এমনও বললেন, “নজরদারি নয়, এটা মাওবাদীদের খবরদারি বটে!”
প্রার্থী তালিকাটাই তার বড় উদাহরণ। এ বারের জেলা পরিষদে গত বারের কোনও প্রার্থীকেই দাঁড় করায়নি সিপিএম। কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকাও গত বারের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে অনেকের ব্যাখ্যা, আতঙ্কের চোরাস্রোত বইয়ে শুধু কথা বা সমঝোতায় যদি কাজ হয়, তা হলে আর সশস্ত্র হামলার দরকার কী? মাওবাদী প্রভাবিত বহু এলাকাই যে আপাত ভাবে এ বার শান্ত, এটাই তার অন্যতম কারণ।
ঘরোয়া আলোচনায় নেতারাও ভোটদাতাদের সঙ্গে একসুর। যদিও প্রকাশ্যে তাঁরা বিপক্ষ শিবিরের দিকেই মাওবাদী সংশ্রবের অভিযোগ ছুড়ে দিচ্ছেন। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপের যেমন অভিযোগ, বহু জায়গায় তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা থেকে ভোটে জিতলে কে সভাধিপতি হবেন, সেই নাম পর্যন্ত মাওবাদীরা ঠিক করে দিয়েছে। একাধিক জনসভায় মণীন্দ্রবাবু দাবি করেছেন, এ বারের ভোটে জনসাধারণের কমিটির এক প্রাক্তন নেতা তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের কাছে খবর আছে, ওই নেতাকে সভাধিপতি করা না হলে তৃণমূলের জেলার মন্ত্রীর লাল বাতি ভাঙা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কংগ্রেসের একাংশের বিরুদ্ধেও মাওবাদীদের সুনজরে থেকে ভোটে জয়ের চেষ্টার অভিযোগ করেছেন বামেরা।
যাঁর গাড়ির লালবাতি নিয়ে চর্চা, তৃণমূলের সেই জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর বক্তব্য, “লালবাতি ভেঙে দেওয়ার গল্পটা লোকে বলছে বটে। কিন্তু ভোটের বাজারে অনেক কিছুই রটে। সবেতে কান দিলে চলে না। এটা বলতে পারি, আমরা জিতলে কে সভাধিপতি হবেন, তা এখনও ঠিক হয়নি। দলের নেত্রী ঠিক করবেন।” শান্তিরামবাবু যোগ করলেন, “বামেরাও বিপ্লবের কথা বলে। মাওবাদীরাও বলে। প্রায় একই বিপ্লবী নীতি-আদর্শ মাথায় রেখে বামেরা মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে শুনতে পাচ্ছি। তাই কে বা কারা আড়াল থেকে কোথায়, কোন দলের প্রার্থী তালিকা ঠিক করে দিচ্ছে, সেটা পুরুলিয়ার আমজনতা বোঝেন।”
মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রার্থী তালিকা তৈরির অভিযোগ যে তাঁদের বিরুদ্ধেও উঠেছে, সে কথা জানানো গেল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক নেপাল মাহাতোকে। শুনে মৃদু হাসলেন। বহু দিন বাদে অযোধ্যা পাহাড়ে বেশ বড়সড় এক মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার ফাঁকে দু’জন সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় দাঁড়িয়ে নেপালবাবু বললেন, “পাহাড়-জঙ্গলে কে কোথায়, কার উপরে নজর রাখে তা কি বলা যায়! এটুকু বলতে পারি, এখন পুরুলিয়ার পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। আরও বদলাবে। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কেউ জেলা পরিষদ গঠন করতে পারবে না। এখনও পুরুলিয়ায় আমরা ডিসাইডিং ফ্যাক্টর।”
আসলে নেতাদের কথোপকথনে একটা বিষয় পরিষ্কার। এত দিন পুরুলিয়া লাগোয়া ঝাড়খণ্ডে যে ভাবে ভোটে মাওবাদীরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে, এখন পশ্চিমবঙ্গেও তাদের কতকটা তেমনই সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। সংগঠন জোরদার করতে গ্রামোন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কোটি কোটি টাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে চায় মাওবাদীরা। তার জন্য পঞ্চায়েত ভোটে আড়াল থেকে কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইছে তারা। তাই তাদের অধ্যুষিত এলাকাগুলির যেখানে যে দলের জেতার সম্ভাবনা, সেখানে সেই মতো অলিখিত বোঝাপড়ার ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছে তারা।
যেমন, বান্দোয়ান ও বরাবাজার এলাকার বেশ কিছু এলাকায় এখনও বামেদের সংগঠনই বেশি জোরদার। সেখানে বেশ কিছু আসনে বামেদের জয়েরই সম্ভাবনা বেশি। তাই ওই সমস্ত এলাকায় বামেদের প্রার্থী তালিকা কী হচ্ছে, সেই ব্যাপারে মাওবাদীরা নিয়মিত নজরদারি চালিয়েছে বলে বাসিন্দাদের অনেকেরই দাবি। ঠিক তেমনই অযোধ্যা-বাঘমুণ্ডি পাহাড়ের কোলঘেঁষা বলরামপুর এলাকায় এখন তৃণমূলই বেশি শক্তি ধরে। গ্রামবাসীদের অনেকেরই ধারণা, তৃণমূলের সেখানকার প্রার্থী তালিকায় প্রভাব খাটিয়েছে মাওবাদীরা। আবার, অযোধ্যা পাহাড়, বাঘমুণ্ডি ও লাগোয়া ঝালদা এলাকায় এখন আগের তুলনায় শক্তি বাড়িয়েছে কংগ্রেস। ফলে, কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকায় যাতে ‘ঠিক লোক’ থাকে, সে দিকে মাওবাদীরা খেয়াল রেখেছে। পাহাড়ের কংগ্রেসের নেতা-সমর্থকদের অনেকেই আড়ালে-আবডালে ব্যাপারটা স্বীকার করছেন।
পুরুলিয়ায় মাওবাদীদের চিহ্নিত ঘাঁটি বান্দোয়ান, বলরামপুর, অযোধ্যা পাহাড়, বাঘমুণ্ডি ও ঝালদার কিছুটা অংশ। এক সময়ে বান্দোয়ানের জঙ্গলে শক্ত ঘাঁটি থাকলেও প্রাক্তন সভাধিপতি তথা সিপিএম নেতা রবীন্দ্রনাথ করকে খুনের পরে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর চাপে মাওবাদীরা অযোধ্যা পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে সরে যায়। অযোধ্যার ঘাঁটি থেকে ঝালদা, বলরামপুর এলাকায় কর্তৃত্ব কায়েম করে তারা। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সিআরপি এবং নাগা বাহিনী অযোধ্যা ও বাঘমুণ্ডিতে তৎপরতা বাড়ানোর পরে আপাতত ঝাড়খণ্ড-পুরুলিয়ার মধ্যবর্তী দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যেই আনাগোনা রয়েছে মাওবাদীদের। তার মধ্যে খেকড়িডি, বেরসা, বাঁধডি, ঘাটবেড়ার মতো প্রত্যন্ত গ্রামে ঝাড়খণ্ড থেকে নিয়মিত রণজিৎ পালের নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের যাতায়াত রয়েছে বলে শাসক ও বিরোধী, দু’পক্ষেরই অনেকের সন্দেহ। |