তরুণী বধূ আত্মঘাতী
স্বামীর পদোন্নতির জন্যও টাকা চেয়ে নির্যাতন
মাত্র ১৯ বছর বয়স মেয়েটির!
স্কুলের গণ্ডী এখনও পেরোননি। বিয়েটা অবশ্য হয়ে গিয়েছিল। দু’মাস আগে বিয়েতে পণ বাবদ লক্ষাধিক টাকা ও সোনার গয়না দেওয়ার পরেও শ্বশুরবাড়ির চাহিদা মেটেনি। জামাইয়ের চাকরিতে পদোন্নতির জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা ঘুষ লাগবে জানিয়ে সেই টাকার বন্দোবস্তও করতে বলা হয়েছিল মেয়ের বাবাকে। এই আবদার মানা সম্ভব হয়নি বড়জোড়ার উড়নপাড়ার বাসিন্দা সূর্যপ্রকাশ ঘোষালের পক্ষে। অভিযোগ, শ্বশুরবাড়িতে তাই মেয়ের উপরে অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। গত ২৫ জুন বাপের বাড়িতে গায়ে আগুন দেন দোয়েল গোস্বামী। রবিবার সকালে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
অথচ মাত্র দু’মাস আগেই মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল পাশের বেলিয়াতোড় থানার রামহরিপুর এলাকার বাসিন্দা, সেনাবাহিনীতে কর্মরত উজ্জ্বল গোস্বামীর সঙ্গে। বিয়েতে পণ বা যৌতুক নেওয়া আইনত নিষিদ্ধ হলেও সমাজের সর্বস্তরে এই ব্যাধি কী ভাবে শিকড় গেড়েছে, দোয়েলের ঘটনা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ বলে মনে করছেন সমাজকর্মীরা। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ রাজ্যে পণের দাবি এখনও ব্যাপক। আমাদের ধর্মীয় শাস্ত্রেই রয়েছে ‘সালঙ্কারা কন্যাদান’ করতে হবে। আজও সেই ধারণার শিকার হচ্ছে মেয়েরা।”
বিয়ের দিন দোয়েল। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে পাওয়া ছবি।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র পরিসংখ্যান বলছে, চাহিদা মতো পণ দিতে না পেরে ২০১২ সালে গোটা দেশে আট হাজারেরও বেশি বধূ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা ৫৯৩। এ ক্ষেত্রে দেশে চতুর্থ স্থানে রয়েছে আমাদের রাজ্য। আর শ্বশুরবাড়িতে বধূ নির্যাতনের অভিযোগের নিরিখে এ রাজ্য দেশে প্রথম।
২৫ জুন বাপের বাড়িতে গায়ে আগুন দেওয়ার পর থেকে দুর্গাপুর মিশন হাসপাতালে চিকিসাধীন ছিলেন দোয়েল। মৃত্যুর আগে পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে তাঁর এই পরিণতির জন্য স্বামী উজ্জ্বল ছাড়াও শ্বশুর ফটিক গোস্বামী, শাশুড়ি বন্দনা গোস্বামী এবং দুই ননদ আশারানি রায় ও তারারানি বটব্যালকে দায়ী করে ওই তরুণী জানিয়েছেন, শ্বশুরবাড়ির নির্মম অত্যাচারেই তিনি এই চরম পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছেন। বড়জোড়ার তৃণমূল বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। মেয়েটির উপরে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অকথ্য অত্যাচার করত। মেয়েটি মৃত্যুকালীন জবানবন্দিও দিয়েছে। দোষীদের কড়া শাস্তির জন্য পুলিশকে বলব।”
বড়জোড়া গার্লস স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন দোয়েল। পড়াশোনার কারণে স্বামী বাইরে থাকায় বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত থাকতেন না। বিয়েতে নগদ দু’লক্ষ টাকা, ১৮ ভরি সোনার গয়না এবং লক্ষাধিক টাকার আসবাবপত্র দিয়েছিলেন দাবি করে সূর্যপ্রকাশবাবুর অভিযোগ, “জামাই বলেছিল চাকরিতে পদোন্নতির জন্য ৫ লক্ষ টাকা লাগবে। সেই টাকাও আমাদেরই দিতে হবে বলে মেয়েকে চাপ দিচ্ছিল। মেয়ে রাজি না হওয়ায় ওরা সবাই মিলে নির্যাতন করত।”
তিনি জানান, উজ্জ্বল সম্প্রতি এক মাসের ছুটিতে বাড়ি ফেরায় দোয়েল শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। ২৪ জুন রাত ন’টা নাগাদ দোয়েল ফোন করে কাঁদতে থাকেন। সূর্যপ্রকাশবাবুর কথায়, “ফোনেই শুনতে পেলাম, ওরা সবাই মেয়েকে গালাগাল দিচ্ছে আর মারছে। আমার মেয়ে আর্তনাদ করছে!” শ্যালক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি মোটরবাইকে চলে আসেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। তিনি জানান, ভিতরে ঢুকে দেখেন, দোয়েলের শরীরের বিভিন্ন অংশ মারের চোটে কেটে গিয়েছে। ওই রাতেই মেয়েকে নিজের সঙ্গে বাড়িতে নিয়ে আসেন সূর্যপ্রকাশবাবু। পর দিন দুপুরেই গায়ে আগুন দেন দোয়েল।
উজ্জ্বলের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি বেঙ্গালুরুতে রয়েছেন বলে জানান তাঁর মা বন্দনা গোস্বামী। তাঁর দাবি, “সব অভিযোগ সাজানো। আমরা বৌমার উপরে কোনও অত্যাচার করিনি। বিয়ের পর মাত্র আট দিন ও শ্বশুরবাড়িতে ছিল।” উজ্জ্বলের পদোন্নতির জন্য দোয়েলের পরিবারের কাছে টাকা চাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার ছেলে ওর বাবার কাছে কোনও দিন হাত পাতেনি, শ্বশুরের কাছে পাতবে? এই অভিযোগও মিথ্যা।” দোয়েলের মস্তিষ্ক বিকৃতি ছিল বলেও দাবি করেছেন তিনি। এ কথা অস্বীকার করেছে দোয়েলের পরিবার। তাদের প্রতিবেশী গোপাল দে, সুমন মুখোপাধ্যায়রাও বলেন, “দোয়েলকে আমরা দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখেছি। ওর কোনও রকম মানসিক বিকৃতি ছিল না। খুব হাসিখুশি, মিশুকে মেয়ে ছিল ও।” রবিবার বিকেলে যখন দোয়েলের দেহ হাসপাতাল থেকে বাপের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়, তখন এলাকার মানুষের ভিড় জমে যায়।
এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখছেন না সুনন্দাদেবী। তিনি জানান, সমস্যার মূলে রয়েছে ১৯৬১ সালের পণপ্রথা রোধের আইনে বলা আছে, বিয়েতে যৌতুক বাবদ যা দেওয়া হচ্ছে, তা লিখিত ভাবে এসডিও-কে জানাতে হবে। “সেই আইন ক’জনই বা জানেন? বধূ নির্যাতন বিরোধী আইন (৪৯৮-এ) যা ১৯৮৩ সালে তৈরি হয়েছিল, সেটাও যাঁদের জন্য, তাঁদের কাজে লাগছে না। বরং পুলিশ থেকে বিচারব্যবস্থাসব জায়গায় রব উঠছে এর ‘অপব্যবহার’ হচ্ছে। ফলে আইনটা ঘুমন্তই থেকে গিয়েছে। মেয়েদের রক্ষা করতে পারছে না।”আক্ষেপ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনের। তবে এ-ও জানিয়েছেন, ১৯ বছরটা মেয়ের বিয়ের বয়স নয়। যে সব অভিভাবক কর্তব্য সারার নামে পণ দিয়ে মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন, তাঁদের প্রতি তাঁর সমর্থন নেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.