প্রবন্ধ ২...
সংস্কারে ধনীরা লাভবান হয়েছে, গরিবরাও
ভারতে অসাম্যের ছবিটা কেমন? প্রথমেই কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। এক, আমরা আয় বা ব্যয়ের অসাম্য হিসেব করছি। অন্য নানা ক্ষেত্রে, যেমন জমির মালিকানায়, অসাম্য থাকতে পারে, আমরা সরাসরি তা দেখছি না। দুই, ভারতে আয়ের সন্তোষজনক পরিসংখ্যান মেলে না। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় (এন এস এস) ভোগব্যয়ের পরিসংখ্যান নেওয়া হয়। এর কারণ, এন এস এস মনে করে, আয়ের তথ্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। এখন, আয় যত বাড়ে, মানুষের সঞ্চয়ের অনুপাত তত বাড়ে। তাই ব্যয়ের অসাম্যের চেয়ে আয়ের অসাম্য বেশি হয়। তিন, এন এস এস প্রতি বছর বড় আকারের সমীক্ষা করে না, করে পাঁচ বছর অন্তর। শেষ বড় নমুনার সমীক্ষা হয়েছে ২০০৯-১০ সালে। চার, এন এস এস পরিবারভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করে। অন্য দিকে, সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন (সি এস ও) মোট ভোগব্যয়ের পরিসংখ্যান নেয়। ঘটনা হল, এন এস এস থেকে পাওয়া পারিবারিক ভোগব্যয় যোগ করলে যে অঙ্ক পাওয়া যায়, সি এস ও’র মোট ভোগব্যয় তার চেয়ে বেশি, এবং ফারাকটা ক্রমশই বাড়ছে। এই সমস্যাটা অন্য দেশেও আছে। পাঁচ, এই পরিসংখ্যান থেকে অসাম্যের একটা নির্দিষ্ট মাপকাঠি পাওয়া যায় না। সে জন্য আমরা জিনি সূচক ব্যবহার করব। এই সূচকটির কথা আগেই বলেছি। মনে করিয়ে দিই, সম্পূর্ণ সাম্য থাকলে জিনি সূচকের মান হয় ০, চরম অসাম্য থাকলে ১। সারণিতে ১৯৯৩-৯৪ এবং ২০০৯-১০, এই দুই সময়ের তথ্য আছে। দুটিই বড় নমুনার সমীক্ষা থেকে পাওয়া।
কয়েকটি ব্যাপার লক্ষণীয়। এক, সাধারণত জিনি সূচক ০.৪০ না ছাড়ালে অসাম্য বেশি বলে মনে করা হয় না। সেই হিসেবে, ভারতে অসাম্যের মাত্রা তুলনায় কম। এটা যে ব্যয়ের অসাম্য, আয়ের নয়, সে কথা মনে রেখেও এটা বলা চলে। দুই, কেরলের মতো ব্যতিক্রম বাদ দিলে, গত দু’দশকে গ্রামীণ ভারতে অসাম্যের মাত্রা মোটামুটি একই আছে। তিন, শহরে অসাম্য বৃদ্ধির কিছু সংকেত আছে,বিশেষ করে মহারাষ্ট্র বা কেরলের মতো রাজ্যে। এটুকু দেখেই বলা যায় না যে, নব্বইয়ের দশকে আর্থিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে অসাম্য বেড়েছে। কিন্তু সংকেতটা খেয়াল করা দরকার।
গ্রাম-শহরের ফারাকটা তাৎপর্যপূর্ণ। গাঁধীজি বলেছিলেন, “ভারত কলকাতা বা বম্বে নয়। ভারত বেঁচে আছে তার সাত লক্ষ গ্রামে।” ২০১১’র জনগণনা অনুসারে, ভারতে গ্রামের সংখ্যা ৬৩৮,৫৮৮। তার মধ্যে ৫৯৩,৭৩২টি গ্রামে জনবসতি আছে। জনগণনায় শহর মানে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের বসতি থাকতে হবে, প্রতি কিলোমিটার এলাকায় গড়ে অন্তত চারশো মানুষ বাস করতে হবে এবং সিকিভাগের বেশি মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল হওয়া চলবে না। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ অনেক গ্রাম বড় হয়, অনেকে শহরের মধ্যে ঢুকে যায়, অনেক গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। ২০১১’র হিসেবে, পাঁচ হাজারের বেশি জনবসতির গ্রামে বাস করেন ২২ শতাংশ গ্রামবাসী, ২০০০ থেকে ৫০০০ মানুষের গ্রামে থাকেন ৩২%, ১০০০ থেকে ২০০০: ২৫%, ৫০০ থেকে ১০০০: ১৪%, বাকি ৭% থাকেন ৫০০’র কম মানুষের গ্রামে। স্পষ্টতই, গ্রামীণ ভারত বলতে এক রকম কিছু বোঝায় না।
পাঁচশোর কম, হয়তো বা হাজারের কম মানুষের গ্রাম দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হওয়া মুশকিল। এত কম লোকের জন্য পরিষেবা এবং পরিকাঠামো (যেমন বিদ্যুৎ, পানীয় জল, ব্যাঙ্ক) সরবরাহ ব্যবস্থা চালানো কঠিন। লোকসংখ্যা দু’হাজার ছাড়ালে এগুলো সরবরাহ করা সুবিধাজনক হয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে, বিশেষ করে রাস্তাঘাটের উন্নতির ফলে বড় গ্রামগুলি খুব দ্রুত শহরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেখানকার শ্রমজীবী মানুষ কৃষি ছেড়ে নির্মাণশিল্প, হোটেল, পরিবহন, হাটবাজারের মতো নানা ক্ষেত্রে কাজ পেয়েছেন। ছোট গ্রামগুলিতে এই সুযোগ অনেক কম। ফলে, বড় গ্রামের সঙ্গে ছোট গ্রামের অসাম্য বেড়েছে। উন্নয়ন তার পরিধিতে ক্রমশই বৃহত্তর এলাকাকে ঢুকিয়ে নেয়, কিন্তু তার বাইরের এলাকাগুলি তুলনায় আরও পিছিয়ে পড়ে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু এর ফলে, সাময়িক ভাবে অসাম্য বাড়ে। বিভিন্ন রাজ্যের শহরাঞ্চলের জিনি সূচকে সম্ভবত সেটাই ধরা পড়ছে।
জিনি সূচক অসাম্যের একটা সূচক। অন্য ভাবেও অসাম্যের হিসেব কষা যায়। অর্থনীতির পরিসংখ্যান নিয়ে বহু মূল্যবান কাজ করছেন লভীশ ভাণ্ডারী। ১৯৯১ সালের পরে ভারতে আয়ের বণ্টন কী ভাবে পালটেছে, তা নিয়ে কিছু কাজ করেছেন তিনি। দেখা যাচ্ছে, আর্থিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে সম্পন্ন কুড়ি শতাংশ মানুষ লাভবান হয়েছেন। কিন্তু এটাও দেখা যাচ্ছে যে, দরিদ্রতম কুড়ি শতাংশও লাভবান হয়েছেন। চাপে পড়েছেন মধ্যবর্তীরা। শহরের ক্ষেত্রে এর একটা কারণ অনুমান করা যায়। সরকারি বা আধা-সরকারি ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করতেন, আর্থিক সংস্কারের ফলে তাঁদের ক্ষতি হয়েছে। তাঁরা আয়ের দিক থেকে মাঝামাঝি বর্গেই পড়েন।
অসাম্যের বহু মাত্রা, বহু দিক। এখানে তার দু’একটি দিক নিয়েই আলোচনা করলাম। আর্থিক সংস্কারের ফলে অসাম্য বাড়ছে, এমন একটা ধারণা বহুলপ্রচলিত। আমাদের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ধারণাটা সম্পূর্ণ অমূলক নয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও স্থির এবং পাকাপাকি সিদ্ধান্ত করার মতো পরিসংখ্যান এখনও আমাদের হাতে নেই।


১৯৯৩-’৯৪
২০০৯-’১০

গ্রাম
শহর গ্রাম শহর
ভারত ০.২৮২ ০.৩৪০ ০.২৯১ ০.৩৮২
অন্ধ্রপ্রদেশ ০.২৮৫ ০.৩২০ ০.২৭৮ ০.৩৮২
অসম ০.১৭৬ ০.২৮৬ ০.২৪৪ ০.৩২৪
বিহার ০.২২২ ০.৩০৭ ০.২২৬ ০.৩৩২
ছত্তীসগঢ় - - ০.২৭৬ ০.৩২৬
গুজরাত ০.২৩৬ ০.২৮৭ ০.২৫৩ ০.৩২৮
হরিয়ানা ০.৩০১ ০.২৮০ ০.৩০১ ০.৩৬০
হিমাচল প্রদেশ ০.২৭৬ ০.৪৩৫ ০.৩০৫ ০.৩৯৯
জম্মু ও কাশ্মীর ০.২৩৪ ০.২৮১ ০.২৩৫ ০.৩০৫
ঝাড়খণ্ড - - ০.২৪০ ০.৩৫৮
কর্নাটক ০.২৬৬ ০.৩১৫ ০.২৩৫ ০.৩৩৪
কেরল ০.২৮৮ ০.৩৩৮ ০.৪১৭ ০.৪৯৯
মধ্যপ্রদেশ ০.২৭৭ ০.৩২৭ ০.২৯২ ০.৩৬৪
মহারাষ্ট্র ০.৩০২ ০.৩৫১ ০.২৬৮ ০.৪১০
ওড়িশা ০.২৪৩ ০.৩০৪ ০.২৬২ ০.৩৮৯
পঞ্জাব ০.২৬৫ ০.২৭৬ ০.২৮৮ ০.৩৭১
রাজস্থান ০.২৬০ ০.২৯০ ০.২২৫ ০.৩৭৮
তামিলনাড়ু ০.৩০৭ ০.৩৪৪ ০.২৬৪ ০.৩৩২
ত্রিপুরা - - ০.২০৫ ০.২৯৪
উত্তরপ্রদেশ ০.২৭৮ ০.৩২৩ ০.৩৫৬ ০৩২৯
পশ্চিমবঙ্গ ০.২৫১ ০.৩৩৪ ০.২৩৯ ০.৩৮৪

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.