|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
একটি রাজনৈতিক ধর্ষণ, ও মুখ্যমন্ত্রী |
একের পর এক নির্বাচনী প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষণ প্রসঙ্গে যা বললেন, তার অঙ্ক ভুল। রাজনীতি ভ্রান্ত।
যৌনহিংসার প্রতিরোধ চেয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে মেয়েদের লড়াইটাই অস্বীকার করলেন তিনি।
স্বাতী ভট্টাচার্য |
ধর্ষণের একটা ঘটনাও ঘটা উচিত নয়, তা নিয়ে বিতর্ক চলে না। কিন্তু রাজ্যে ধর্ষণ-সহ নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে কি না, সে প্রশ্নটা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। না হলে বোঝা যাচ্ছে না, ধর্ষণের প্রতিরোধ করতে তৃণমূল সরকারের যে ব্যর্থতা, তা কি আদতে সি পি আই এম সরকারের বানতলা-সুটিয়ায় ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা? না কি তৃণমূলের রাজনীতিতে এমন কোনও খামতি রয়েছে যা মেয়েদের বিপদ বাড়াচ্ছে?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্টে দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের উপর অপরাধ হচ্ছে দেশের মধ্যে সব চাইতে বেশি। প্রায় একই সঙ্গে কামদুনি, গেদের ধর্ষণ ঘটল, রব উঠল যে রাজ্যে দ্রুত বাড়ছে নারী নির্যাতন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বললেন, তাঁর সরকার আসার পর মেয়েরা নির্ভয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করছে। নির্যাতনের অভিযোগ যে বাড়ছে, তাতে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতিই বোঝাচ্ছে, এই হল তাঁর দাবি।
এটা নিখাদ রাজনৈতিক বক্তব্য, কিন্তু কথাটা উড়িয়ে দেওয়া চলে না। কথা না বলার চাপ সত্যিই তো থাকে মেয়েদের উপর। আবার মেয়েদেরও পুলিশের উপর আস্থা থাকে না। নানা রাজ্যে, নানা দেশে, এ বিষয়ে নিজস্ব একটা সংস্কৃতিই গড়ে ওঠে। লন্ডন মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যে সব দেশে মেয়েরা স্বাধীনতা, মর্যাদার দিক থেকে এগিয়ে, সেই সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ব্রিটেনে ইউরোপের সর্বাধিক ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। সব চাইতে কম হয় হাঙ্গেরি, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়ার মতো দক্ষিণ বা পূর্ব ইউরোপের দেশে, যেখানে মেয়েদের হাল তুলনায় খারাপ। |
|
তাই ধর্ষণের অভিযোগ বেশি হলেই সেখানে মেয়েরা বেশি বিপন্ন, এমন ধরে নেওয়া চলে না। মেয়েরা যেখানে বেশি স্বচ্ছন্দ, আত্মবিশ্বাসী, সেখানে তারা লজ্জায়-ভয়ে নির্যাতন লুকিয়ে না-রেখে প্রকাশ্যে জানাবে, বিচার চাইবে, এমনটাই স্বাভাবিক। মুখ্যমন্ত্রী সেই যুক্তিতেই দাবি করতে পারেন, তৃণমূল সরকার রাজ্যের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে পেরেছে বলে ধর্ষণের অভিযোগ বাড়ছে। কথাটা সত্যি হলে, তৃণমূল আসার পর মেয়েদের উপর নির্যাতন ঘটলে অভিযোগের হার এক লাফে অনেকটা বেড়ে যাওয়ার কথা। সত্যিই কি তাই হয়েছে?
ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান কিন্তু উলটো সাক্ষ্যই দিচ্ছে (বক্স দেখুন)। মেয়েদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ আগের চাইতে অনেকটা বেড়েছে, এই ধারণাই ভুল। তাই ‘কেন অভিযোগ বাড়ছে’ তার উত্তর খোঁজার মানেই হয় না। বরং ভারতে পরিসংখ্যান যে ছবি আঁকছে, তাতে যেন ইউরোপের ছবির প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপে বরাবরই সুইডেন বা ব্রিটেনে অভিযোগের হার এক লক্ষে দশ বা তার বেশি, সেখানে গ্রিস-ক্রোয়েশিয়ায় এক লক্ষে দেড় কি দুই। ভারতেও দেখা যাচ্ছে, বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গে অভিযোগ এক লক্ষে আড়াই থেকে চার, কিন্তু বিহার, উত্তরপ্রদেশ অভিযোগ পাচ্ছে এক থেকে দেড়। তা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এক রাজ্যে ধর্ষণ অন্য রাজ্যের চাইতে বেশি হচ্ছে না কম, এর কোনও নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া কঠিন। নানা রাজ্যে অভিযোগ কম-বেশি হচ্ছে, না কি অপরাধ কম-বেশি হচ্ছে, সেই সংশয় থেকেই যাবে।
কিন্তু যা লক্ষ করার মতো, তা হল যে প্রায় সব রাজ্যেই ধর্ষণের অভিযোগের একটা হার মোটামুটি স্থিতিশীল হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত একটা প্রশাসনিক সংস্কৃতির জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে ধর্ষণের অভিযোগের হারে খুব বেশি হেরফের হচ্ছে না। সেই জন্য কোনও নির্দিষ্ট রাজ্যের সম্পর্কে বরং প্রশ্ন করা চলে, অভিযোগের হার বাড়ছে না কমছে। সে প্রশ্ন অর্থপূর্ণ হবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তার উত্তর, অভিযোগের হার বাড়েনি।
মুখ্যমন্ত্রী আগাগোড়াই রাজনৈতিক অস্ত্রে ধর্ষণের অভিযোগের মোকাবিলা করতে গিয়ে অঙ্কে ভুল করলেন। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে, তাই আরও বেশি মেয়ে নির্ভয়ে থানায় গিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ লেখাতে পারছে -- এই ছবিটা মুখ্যমন্ত্রী বারবার তুলে ধরলেন। কিন্তু এটা রাজ্যের ছবি নয়। বরং তিনি বলতে পারতেন, অভিযোগ বাড়ছে, এটাই বিরোধীদের অপপ্রচার। মোট সংখ্যা দিয়ে না দেখে, জনসংখ্যার নিরিখে বিচার করলেই তা বোঝা যেত।
কামদুনির টুম্পা-মৌসুমীদেরও কেউ বলেনি যে, রাজ্যে ধর্ষণ আগেও যেমন এখনও তেমন। নইলে মুখ্যমন্ত্রী যখন তাদের ‘সি পি এম-এর রাজনীতি’ করার জন্য ধমক দিলেন, তখন তারা বলতে পারত, “আপনিও তো তা-ই করছেন।” যে রাজনীতি ধর্ষণের সংখ্যা দিয়ে ধর্ষণের গুরুত্ব বিচার করে, যে রাজনীতি ধর্ষণকারীর প্রতি যত না অসহিষ্ণু, তার চাইতে ঢের বেশি অসহিষ্ণু ধর্ষণের অভিযোগের প্রতি, সে তো বহু দিনের চেনা রাজনীতি।
|
বুদ্ধ-মমতা বনাম মেয়েরা |
কিন্তু তার চাইতেও বড় অভিযোগ রয়েছে। সি পি এম-এর রাজনীতির চাইতে খারাপ যদি কিছু হয়, তবে তা অ-রাজনীতি। রাজনৈতিক বোধের অভাব।
ক্ষমতার বণ্টনই রাজনীতি। ভাল রাজনীতি মানুষে-মানুষে ক্ষমতায় সমতা আনে। খারাপ রাজনীতি বৈষম্য তৈরি করে, বৈষম্য বজায় রাখে। মেয়েদের সক্ষমতা, মেয়েদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার সব চাইতে সহজ যে উপায় পুরুষদের হাতে রয়েছে, তা হল যৌন হিংসা। এক লক্ষে দুটি কি তিনটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়, কিন্তু তার বার্তা যায় এক লক্ষ মেয়ের কাছেই। “তুমি স্কুল-কলেজে বেশি নম্বর পেতে পারো, বেশি রোজগার করতে পারো, ভোটে দাঁড়িয়ে হারিয়েও দিতে পারো, কিন্তু আমি তোমাকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলতে পারি। তোমার চলাফেরা, কথা বলা, তত ক্ষণই যত ক্ষণ আমি তোমাকে তা করতে দিচ্ছি। ভুলে যেও না তুমি মেয়ে,” এই হল সেই দুর্বিনীত ক্ষমতার বার্তা। ধর্ষণের সংখ্যা যতই হোক, এই বার্তার তীব্রতা কমে না। কামদুনির মতো বহু গ্রামে-শহরে বহু মেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, আসা-যাওয়ার পথে গায়ে হাত পড়ার ভয়ে। তারা সকলেই কি ‘ধর্ষণের শিকার’ নয়?
মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষণের এই রাজনীতিটা বেমালুম চেপে গেলেন। একের পর এক জেলায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তিনি বললেন, মা-বোনেরা আমাদের সম্পদ। ভাইয়েরা বোনেদের ভালবাসবে। বোনেরা ভাইদের ভালবাসবে। সব পুরুষই তো আর খারাপ নয়। কয়েকটা ঘটনাকে বড় করে দেখাচ্ছে মিডিয়া।
মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে বামপন্থী বলতে ভালবাসেন। অথচ দরিদ্র-ধনীর মতোই, নারী-পুরুষের মধ্যেও যে ক্ষমতার প্রশ্নে শ্রেণি-সংঘাত রয়েছে, সেই বোধ তাঁর কথায় ধরাই পড়ল না। পুরুষ কখনওই স্বচ্ছন্দে-সানন্দে মেয়েদের দেহ এবং শ্রমের উপর তার অধিকার ছাড়বে না। কখনও আইন দিয়ে, কখনও চড়-কিল-ধর্ষণ দিয়ে মেয়েদের বশে রাখতে চাইবে, বামপন্থী নারীবাদের এই মূল দৃষ্টিভঙ্গি মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ‘ভাই-বোন’ ব্যাখ্যা দিয়ে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।
আরও ভয়ঙ্কর তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি কি ধর্ষণ করেছি?” এ কথাটা নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে বেশি। কিন্তু কথাটা তাঁর স্থান নির্দিষ্ট করল নারী আন্দোলনের উলটো দিকে। সত্তরের দশক থেকে নারী আন্দোলন বলে আসছে, রাষ্ট্র নারী নির্যাতনের অংশিদার। রাষ্ট্রের মদত না থাকলে নারীপাচার, পণহত্যা, ধর্ষণ চলতে পারে না এত ব্যাপক হারে। রাষ্ট্রের সেই মুখ বদলাতে মেয়েরা বারবার রাস্তায় নেমেছে। ধর্ষণের আইন বদলে, প্রশাসনের নিয়ম-কানুনে মেয়েদের জায়গা করে দিয়ে, পুলিশের আচরণবিধিতে রদবদল এনে প্রমাণ করতে চেয়েছে, এই দেশ মেয়েদেরও দেশ। মেয়েদের সক্ষমতা কমানোর উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করা অন্যায়।
মেয়েরা যে নিজেদের হিংসা থেকে বাঁচাতে পারে না, সেই ক্ষমতাহীনতার উপর ভারতের সমাজ-সংসার দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরে-বাইরে নির্যাতন সেই সমাজব্যবস্থাকে পোক্ত করছে। এই হল ভারতের ক্ষমতা-কাঠামোর বুনিয়াদ। দলীয় রাজনীতি এই সত্যকে এড়িয়ে গিয়েছে। তাই গণতন্ত্রেও সরকার মেয়েদের প্রতি কর্কশ, সন্দিগ্ধ, নির্বিকার। সিপিএম নীতিগত ভাবে তা স্বীকার করেও, কাজের বেলায় ধর্ষণ-বধূহত্যাকে মেয়েদের সক্ষমতার পরিপন্থী বলে স্বীকৃতি দেয়নি। ক’টা ধর্ষণ, গুণতে বসেছে। তাই নারীহিংসার অভিযোগ উঠলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরিসংখ্যান দিয়ে বলতেন, অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ মরূদ্যান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রচারে স্পষ্ট, তিনি রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিকতার তত্ত্বও স্বীকার করেন না। রাজনীতি যে রাষ্ট্রের মোকাবিলা করে মেয়েদের ক্ষমতা বাড়াতে পারে, সেই সম্ভাবনাই তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। এমন প্রবল অ-রাজনীতির কারণ স্পষ্ট— দলের ‘ভাইরা’ চটে গেলে ভোটের গুনতি চোট খেতে পারে। তাদের নিশ্চিন্ত করতে নিজের নারীত্বকে মুখ্যমন্ত্রী ব্যবহার করছেন রাষ্ট্রক্ষমতার নারীবিদ্বেষকে আড়াল করতে। তিনি মেয়ে, তিনি ধর্ষণ করবেন, এ বিশ্বাস করা যায় না। অতএব তাঁর সরকার, তাঁর পুলিশ মেয়েদের প্রতি নিষ্ঠুর কি না, সেই প্রশ্নই ওঠে না।
এ ভাবেই নির্যাতনের জমি তৈরি হয়। বাকিটুকু সময়-সুযোগের অপেক্ষা।
|
ধর্ষণ বেড়েছে? সংখ্যা তা বলছে না |
জয়দীপ চক্রবর্তী |
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিক ভাবে নারী নির্যাতনের অভিযোগ ২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রতি বছরই ক্রমাগত বেড়েছে। প্রথম তিন বছরে প্রতি বছর ৪০০০ মতো অভিযোগ বেড়েছে। পরের দুই বছর বেড়েছে ৩০০০ করে। বরং ২০১১-১২ সালে অভিযোগ বেড়েছে কেবল হাজারখানেক। ২০০৬-২০১২, এই ছয় বছরে শতাংশের হিসেবে অভিযোগ বৃদ্ধির হার হিসেব করলে তা দাঁড়ায় ২৯-২৬-১১-১২-১২-৬। মানে, তৃণমূল আসার পরেই অভিযোগ দ্রুত বাড়ছে, এমন নয়। বরং সি পি আই এম ২০০৬ সালে বিপুল ভোটে জিতে আসার পর নির্যাতনের অভিযোগ এক বছরে এক লাফে প্রায় সাড়ে চার হাজার বেড়েছিল।
অন্যান্য নির্যাতন বাদ দিয়ে কেবল ধর্ষণের হিসেব ধরলে, মোট অভিযোগের সংখ্যা কিছু কমেছে। আগের বছরের তুলনায় ২০১২-১৩ সালে ৩১৭টি অভিযোগ কম দায়ের হয়েছে। তবে জনসংখ্যার নিরিখে বিচার করলে, ধর্ষণের হার পশ্চিমবঙ্গে আশ্চর্য ভাবে থেমে আছে একই জায়গায়। ২০০৭ থেকে ২০১২, এই পাঁচ বছরে প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় ২.৬ - ২.৩, একটানা এমন জায়গাতেই রয়ে গিয়েছে। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে মধ্যপ্রদেশে ওই হার বরাবরই ৪.৫-এর মতো। রাজস্থানে বরং প্রতি বছর অল্প অল্প বেড়ে এ বছরই পশ্চিমবঙ্গকে ছাড়িয়ে হয়েছে এক লক্ষে ৩। ধর্ষণের হারে সব চাইতে খারাপ দশা মিজোরামের। সেখানে এক লক্ষে ৯ থেকে ১১, এর মধ্যেই ধর্ষণের হার ঘোরাফেরা করছে গত পাঁচ বছর।
|
|
|
|
|
|