রথযাত্রা আসছে সামনেই। জগন্নাথের রথের রশিতে টান পড়বে।
রশিতে টান পড়বে চিৎপুরের যাত্রাপালারও। ফি বছর ওই দিনেই যাত্রাপাড়ার মরসুম শুরু হয়। চারদিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন পালা ঘোষণা করে দলগুলি।
কিন্তু জেলার যাত্রাদল? তাদের মরসুমই বা কী আর মহরতই বা কী? তাদের তো টিকে থাকাই দায়। বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই সব ছোট দল যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়, তার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে রাজ্য সরকারের গড়া পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা অ্যাকাডেমি। এই বছর রথে সেই অ্যাকাডেমিতেও নতুন মরসুম শুরুর পুজো হবে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা উৎসবের পরেই গ্রামের যাত্রা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। যাত্রা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, “যাত্রার সঙ্গে কেবল শিল্পীরাই নন, অসংখ্য কলাকুশলী, কর্মীদের রুজি-রোজগার জড়িত। সরকার বাংলার যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে চায়। মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন।”
গত বছরই যাত্রা উৎসবের উদ্বোধন কলকাতায় না করে জেলায় করা হয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে সেই অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে যাত্রা অ্যাকাডেমির সদস্য-সচিব তপন সরকার বলেন, “এ বছরও প্রতি জেলায় যাত্রা উৎসব করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাকে আরও বড় চেহারা দেওয়া হবে। গ্রামবাংলার যাত্রা দলগুলি নিজেদের যাত্রা তুলে ধরার সুযোগ পাবে।” মন্ত্রীর মতে, “জেলা ও কলকাতার মধ্যে যোগাযোগ শুরু হলেই গ্রামবাংলার যাত্রাশিল্পের উন্নতি হবে।”
কিন্তু জেলার যাত্রাদলগুলির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় সীমিত সামর্থ্যে পাল্টে যাওয়া সময়ের মোকাবিলা করা। আগেকার ‘শোনার’ স্তর পেরিয়ে যাত্রা এখন রীতিমতো ‘দেখার’ বিষয়। যাত্রা-গবেষক দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “ব্যাপারটা কার্যত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের চেহারা নিয়েছে। ফিল্মের তারকারা যাত্রায় অভিনয় করেন। তাঁদের টানে ভিড় হয়। শব্দ ও আলোয় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মতো নানা আকর্ষণও রয়েছে।”
দেবজিত্বাবুর ব্যাখ্যা, সাবেক যাত্রাপালায় কাহিনির টানেই লোকে ভিড় করত। তাই বারংবার অভিনীত হওয়ার পরেও পালার আকর্ষণ বজায় থাকত। এখন গল্প কমজোরি হয়ে যাওয়ায় নানা জাঁকজমক সত্ত্বেও পালার প্রতি টান দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই যাত্রা দলগুলি কিছু দিন বাদে বাদেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বদল করে। জেলার দলগুলির পক্ষে যা আদৌ সম্ভব নয়, যেমন অসম্ভব দামি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাক লাগানো। এমনকী কোথাও যাত্রা উৎসবে যোগ দিতে যাওয়ার মতো টাকাকড়িও অনেকের নেই।
বর্ধমানের হিরাপুরের লোকনাথ বাবা যাত্রা সমাজের কর্ণধার শচীনদেব বর্মন যেমন জানান, গত বছর রাজ্যব্যাপী যাত্রা উৎসবে ডাক পেয়েও আর্থিক সমস্যার কারণে যেতে পারেননি। তাঁর আক্ষেপ , “বাঁশ-ত্রিপলের অস্থায়ী ঘরে আমাদের মহড়া দিতে হয়। আর খরচ কোত্থেকে জোগাব?” হিরাপুরেরই মানিকচাঁদ ঠাকুর যাত্রা সমাজের অন্যতম কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ ঠাকুর বলেন, “যাত্রা করে সংসার চলে না। আমাদের প্রায় সব শিল্পীই অন্য পেশায় যুক্ত।”
এই অবস্থায় টিকে থাকার জন্য সরকারি সহায়তার দিকেই চেয়ে আছেন যাত্রাশিল্পীরা। সরকারও তাতে উৎসাহী। মন্ত্রী অরূপবাবু বলেন, “সরকারি যাত্রা উৎসবে গ্রামের যে দলগুলি যোগ দেবে তাদের স্পনসরশিপ ও সাম্মানিক দেওয়ার বিষয়টি পরিকল্পনায় রয়েছে। আশা করি, তাতে আগামী দু’এক বছরের মধ্যেই ওই যাত্রাদলগুলির অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেকটাই উন্নত হবে।”
পূর্ব মেদিনীপুরের তিনটি যাত্রা সংস্থার কর্ণধার মুকুন্দ মাইতির মতে, “জেলায়-জেলায় যাত্রা উৎসব হলে যাত্রার জনপ্রিয়তা ফিরে আসতে পারে।” তবে কলকাতার প্রতি জেলার একমুখো নির্ভরতা নয়, বরং দুই তরফের পারস্পরিক নির্ভরতা গড়ে তুলতে চাইছে অ্যাকাডেমি। তাতে কলকাতার বড় দলগুলির পক্ষেও প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছনোর সুবিধা হবে। অরূপবাবু জানান, অ্যাকাডেমির তরফে চিৎপুরের দলগুলির পালার নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর সংবলিত একটি ‘ব্রোশিওর’ তৈরি করে সেটি জেলায়-জেলায় বিভিন্ন দফতরে ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এতে গ্রাম-শহরের যোগাযোগের সুবিধা হবে।
এই রশির টানে যাত্রার রথ গড়গড় করে গড়ায় কি না, তা অবশ্য শেষমেশ দর্শকেরাই বলবেন। |